মৌর্য সাম্রাজ্য : মৌর্যযুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎকর্ষ দেখা গিয়েছিল। যেমন—
1. মৌর্য সাম্রাজ্য কৃষির বিকাশ
মৌর্য যুগে কৃষিকাজে লোহার যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল এবং কৃষিজমিতে জলসেচের সুবন্দোবস্ত ছিল। এর ফলে এ যুগে কৃষি উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কৃষিই ছিল জনসাধারণের প্রধান জীবিকা। কৃষির উন্নতিতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ধান ও গম ছিল প্রধান কৃষিজ ফসল। এ ছাড়া কলাই, তিল, সরিষা, বিভিন্ন সব্জি ও ফলের চাষ হত। তবে বিভিন্ন ধরনের করের চাপে মৌর্য যুগের কৃষকরা নিপীড়িত ছিল।
2. মৌর্য সাম্রাজ্য শিল্পে অগ্রগতি
মৌর্য যুগে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। লোহা, কাঠ, চামড়া, বাঁশ, পাথর প্রভৃতি উপাদান বিভিন্ন শিল্প উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হত। কাঠ দিয়ে যুদ্ধের জন্য রথ এবং পণ্য পরিবহণের জন্য গোরুর গাড়ি তৈরি হত। ধাতুশিল্পের বিকাশের ফলে যুদ্ধের অস্ত্র ও গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী নির্মিত হত। সোনা ও রুপোর অলংকারশিল্পেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। বস্ত্র-বয়নশিল্পে, বিশেষ করে রেশম ও কার্পাস বস্ত্র উৎপাদনে এসময়ে বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল। এ ছাড়া মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প, ঔষধপত্র ও সুগন্ধি উৎপাদন শিল্প, নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রভৃতি শিল্পের কাজেও যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল।
3.মৌর্য সাম্রাজ্য বাণিজ্যের প্রসার
মৌর্য যুগে কৃষি ও শিল্পের উপর ভিত্তি করে বাণিজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। এসময় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় বাণিজ্যই চালু ছিল। দেশের বিভিন্ন রাজপথগুলি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। স্থল, নদী ও সমুদ্রপথে দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে মৌর্য যুগে বাণিজ্যিক পণ্য আদান প্রদান করা হত। এ যুগের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল তক্ষশিলা, চম্পা, পাটলিপুত্র, বারাণসী, কোশাম্বী প্রভৃতি। ভৃগুকচ্ছ, সোপারা, কল্যাণ, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি ছিল এ যুগের উল্লেখযোগ্য সমুদ্রবন্দর। এই সময় বিদেশ থেকে ভারতে যুদ্ধের ঘোড়া, সোনা, নীলকান্ত মণি, কাচ প্রভৃতি আমদানি করা হত এবং ভারত থেকে বিদেশে দামি পাথর, হাতির দাঁতের সামগ্রী, সুতি কাপড়, রেশম, চাল, মশলা, সুগন্ধি দ্রব্য প্রভৃতি রপ্তানি করা হত।
4. মৌর্য সাম্রাজ্য ধর্মীয় জীবন
মৌর্য যুগে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মৌর্য সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই ধর্মপ্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধর্ম সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অশোকের উদ্যোগে বৌদ্ধধর্ম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং ভারতের বাইরে চিন, সিংহল, সিরিয়া, মিশর, কাইরেনি, ম্যাসিডন, এপিরাস প্রভৃতি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এজন্য ঐতিহাসিক এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, ভারতের গাঙ্গেয় অঞ্চলে প্রচারিত একটি ধর্মমত অশোকের চেষ্টায় বিশ্বধর্মে পরিণত হয়েছিল। অবশ্য বৌদ্ধধর্মের পাশাপাশি এসময় ব্রাহ্মণ্যধর্ম, জৈনধর্ম, আজীবিকধর্ম প্রভৃতির অস্তিত্ব এবং শিব, কার্তিক প্রভৃতি লৌকিক দেবতার পূজার প্রচলন ছিল।
5. মৌর্য সাম্রাজ্য শিল্পকলার উৎকর্ষ
প্রাচীন ভারতে সর্বপ্রথম মৌর্য যুগেই শিল্পকলার ক্ষেত্রে সর্বাধিক উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, “সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় স্থাপত্য ও শিল্প মূলত অশোকের সময় থেকে শুরু হয়েছিল।” গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস মৌর্য রাজপ্রাসাদের শিল্পকার্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এর প্রায় ৫০০ বছর পর চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনও মৌর্যদের রাজধানী পাটলিপুত্র নগরীর কারুকার্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। মৌর্য যুগের বিভিন্ন স্তূপ, গুহা স্থাপত্য ও স্তম্ভগুলি ছিল শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, অশোকের সময় ৮৪০০০ স্তূপ নির্মিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাঁচির স্তূপ যাঁর অস্তিত্ব আজও অম্লান। কুমারহারের বিখ্যাত হলঘর, নাগার্জুন গুহা, দশরথ গুহা, সুদাম গুহা প্রভৃতিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ যুগে নির্মিত বিভিন্ন স্তম্ভ এবং স্তম্ভের শিখরে সিংহ, ষাঁড় বা অন্যান্য পশুমূর্তি ও কারুকার্য শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
6. মৌর্য সাম্রাজ্য জাতিভেদপ্রথা
মৌর্য যুগে ভারতে জাতিভেদপ্রথার তীব্র প্রকোপ ছিল বলে জানা যায়। মৌর্য যুগে ভারতে আগত গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তাঁর ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ভারতে সাতটি জাতির অস্তিত্ব ছিল। যথা— দার্শনিক, সৈনিক, পরিদর্শক, কৃষক, শিল্পী, সভাপণ্ডিত ও পশুপালক। অবশ্য অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন যে, মৌর্য যুগে ভারতে বৈদিক যুগের চতুর্বর্ণপ্রথাই ব্যাপকভাবে অস্তিত্বশীল ছিল। তাদের মতে মেগাস্থিনিস সম্ভবত ভারতের চতুর্বর্ণের স্বরূপ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
7. মৌর্য সাম্রাজ্য দাসপ্রথা
মৌর্য যুগে ভারতে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল না বলে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস উল্লেখ করলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে মৌর্য যুগে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন শ্রেণির দাসের উল্লেখ করা হয়েছে। এ যুগের দাসরা ছিল মূলত গৃহকার্যে নিযুক্ত। অনেক সময় যুদ্ধবন্দিদের দাসে পরিণত করা হত বা দাস হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে বিক্রয়ও করা হত। তবে রোমান সভ্যতায় ক্রীতদাসদের প্রতি যতটা অমানবিক আচরণ করা হত তা মৌর্য যুগের দাসদের সঙ্গে করা হত না।
৪. মৌর্য সাম্রাজ্য শিক্ষার অগ্রগতি
মৌর্য যুগে বিদ্যাচর্চার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। পাণিনির ১৫০০টি সূত্রের ওপর টীকার রচয়িতা কাত্যায়ন ছিলেন মৌর্য যুগেরই মানুষ। এ যুগের অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকার ও পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন গৌতম, বৌধায়ন, বশিষ্ঠ, আপস্তম্ব প্রমুখ। রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণগুলির সংকলন মৌর্য যুগেই হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এ যুগে সাহিত্য, ছন্দ, ব্যাকরণ, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ের যথেষ্ট চর্চা হত। তক্ষশিলা, উজ্জয়িনী, বারাণসী প্রভৃতি স্থান উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিল।