ভারতে হিন্দু সম্পত্তি আইন একটি জটিল কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা উত্তরাধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, এবং বণ্টনের নিয়ম নিয়ে গঠিত। এই আইন প্রধানত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬ এবং এর ২০০৫ সালের সংশোধনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে সম্পত্তির ধরন, উত্তরাধিকারের শ্রেণিবিভাগ, নারীদের অধিকার, এবং সাম্প্রতিক আইনি পরিবর্তনসহ প্রতিটি দিক বিশদে আলোচনা করা হলো:

১. ঐতিহাসিক পটভূমি
হিন্দু আইনের মূল ভিত্তি প্রাচীন স্মৃতি ও ধর্মগ্রন্থ যেমন মিতাক্ষরা ও দায়ভাগ মতবাদ। মিতাক্ষরা পদ্ধতিতে পুত্র জন্মসূত্রে সম্পত্তির অধিকারী হন, অন্যদিকে দায়ভাগ পদ্ধতিতে পিণ্ডদানের অধিকারী ব্যক্তিই উত্তরাধিকারী হন । তবে ১৯৫৬ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রথাগত ব্যবস্থাকে সংহত করা হয়, যা ২০০৫ সালে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সংশোধিত হয় ।
২. সম্পত্তির প্রকারভেদ
ক) পৈতৃক সম্পত্তি (Ancestral Property)
- চার পুরুষ (পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, এবং কুলপিতা) থেকে প্রাপ্ত অবিভক্ত সম্পত্তি ।
- পুত্র-কন্যা উভয়েরই জন্মসূত্রে সমান অধিকার রয়েছে ।
- বাবা এই সম্পত্তি বিক্রি বা দান করতে পারেন না ।
খ) স্ব-অর্জিত সম্পত্তি (Self-Acquired Property)
- ব্যক্তির নিজস্ব উপার্জন বা উপহারে প্রাপ্ত সম্পত্তি ।
- মালিক ইচ্ছানুযায়ী উইলের মাধ্যমে বণ্টন করতে পারেন ।
৩. উত্তরাধিকারের শ্রেণিবিভাগ
ক) শ্রেণী-I উত্তরাধিকার
- তাত্ক্ষণিক পরিবার: পুত্র, কন্যা, বিধবা, মাতা, মৃত পুত্রের সন্তান ।
- সম্পত্তি সমান ভাগে বণ্টিত হয় ।
খ) শ্রেণী-II উত্তরাধিকার
- দূরবর্তী আত্মীয়: পিতা, ভাই, বোন, দাদা-দাদি ।
- শ্রেণী-I উত্তরাধিকারী না থাকলে প্রয়োগ হয় ।
গ) কপারসনারি ব্যবস্থা
- হিন্দু যৌথ পরিবারে (HUF) পুরুষ সদস্যদের সাথে কন্যারাও সমান অধিকার পায় (২০০৫ সংশোধনী) ।
- কন্যা এখন সম্পত্তি বিভাজন দাবি করতে পারে ।
৪. নারীদের অধিকার
- কন্যাদের অধিকার: ২০০৫ সালের সংশোধনীর পর বিবাহিত বা অবিবাহিত সকল কন্যা পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান ভাগ পায় ।
- বিধবাদের অধিকার: স্বামীর সম্পত্তিতে জীবনস্বত্ব (Life Interest) ভোগ করেন, তবে পুনর্বিবাহ করলে অধিকার হারান ।
- মাতার অধিকার: শ্রেণী-I উত্তরাধিকারী হিসেবে সমান অংশ পান ।
৫. বিশেষ ক্ষেত্র
- দত্তক পুত্র: দত্তক সন্তান স্বাভাবিক পুত্রের ১/৩ অংশ পায় ।
- অযোগ্যতা: ধর্মত্যাগ, হত্যাকাণ্ড, বা সন্ন্যাস গ্রহণ করলে উত্তরাধিকার বাতিল ।
- জীবনস্বত্ব: বিধবা বা কন্যা শুধু সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন, বিক্রি বা হস্তান্তর নয় (কৃষিজমি ব্যতীত) ।
৬. সাম্প্রতিক সংশোধনী ও মামলা
- ভিনীতা শর্মা বনাম রাকেশ শর্মা (২০২০): সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে ২০০৫ সালের সংশোধনী পিতার মৃত্যুর আগে জন্ম নেওয়া কন্যাদেরও প্রযোজ্য ।
- ইউনিফর্ম সিভিল কোড: ধর্মনিরপেক্ষ আইন চালুর প্রস্তাব হিন্দু আইনে প্রভাব ফেলতে পারে ।
৭. প্রয়োগিক দিক
- উইল প্রণয়ন: স্ব-অর্জিত সম্পত্তি বণ্টনের সর্বোত্তম পদ্ধতি ।
- লিগাল হিয়ার সার্টিফিকেট: সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ।
- বিবাদ নিষ্পত্তি: পারিবারিক বিভাজন বা আদালতের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি ।
৮. চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
- প্রথাগত রীতি: গ্রামীণ এলাকায় নারীদের অধিকার এখনও সীমিত ।
- কৃষিজমি বণ্টন: কিছু রাজ্যে রাজ্য আইন হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ।
উপসংহার
হিন্দু সম্পত্তি আইন সময়ের সাথে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ন্যায়ের দিকে এগিয়েছে। তবে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে উইল প্রণয়ন এবং আইনি পরামর্শ গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
Also Read — নাবালক সম্পত্তি আইন: নীতি, বিধান ও প্রয়োগ
হিন্দু সম্পত্তি আইন ২০২২: ভারতের উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ
শত্রু সম্পত্তি আইন: ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, এবং বর্তমান বিতর্ক
ইসলামিক সম্পত্তি আইন: কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সম্পত্তি বণ্টনের বিস্তারিত গাইডলাইন