বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন
মির নিশার আলি বা তিতুমিরের ( 1782-1831 খ্রিস্টাব্দ ) নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসে এই আন্দোলন বারাসত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। প্রধানত উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভির ( 1786-1831 খ্রিস্টাব্দ ) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিতুমির বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের ডাক দেন।
ইসলামের শুদ্ধিকরণের জন্য আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব ( 1703-1787 খ্রিস্টাব্দ ) নামে এক ব্যক্তি ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ওয়াহাবি শব্দের অর্থ *নবজাগরণ*। ভারতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন দিল্লির এক মুসলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ ( 1703-1787 খ্রিস্টাব্দ ) কিন্তু এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওহাবি আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রেফতখন রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভি বা সৈয়দ আহমেদ। তিতুমির হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমেদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন
ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ
ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল প্রধানত ইসলামের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। সৈয়দ আহমেদ ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতকে দার-উল-হারব বা বিধর্মীদের দেশ হিসেবে অভিহিত করেন এবং ধর্মযুদ্ধের দ্বারা এই দেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ইসলামের পবিত্রভূমি’ – তে পরিণত করার আহ্বান জানান। তিতুমির প্রধানত সৈয়দ আহমেদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই সৈয়দ আহমেদের মতাে তিতুমিরের আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শদ্ধিকরণ।
পাশাপাশি সুদখাের মহাজন, জমিদার ও নীলকরদের শাষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলাও তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। এই কারণে ড . বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, তিতুমিরের বিদ্রোহ ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন হিসেবে শুরু হলেও তা প্রথমে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এবং পরে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল।
অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তিতুমির দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে এক সংগঠন গড়ে তােলেন। 1830 খ্রিস্টাব্দের 6 নভেম্বর তিতুমির প্রায় 300 অনুগামী নিয়ে পুড়ার জমিদার কৃষ্ণুদেব রায়কে আক্রমণ করেন। মৈনুদ্দিন ও গােলাম মাসুম ছিলেন তিতুর বাহিনীর যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি। ইংরেজ রাজত্বের অবসানকল্পে তিনি নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘােষণা করেন ।
ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তার ও পরিণতি
তিনি চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার অন্তর্ভুক্ত নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে তার আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র যাপন করেন। বারাসত মহকুমায় অবস্থিত বলে এই বিদ্রোহের অপর নাম হয় বারাসত বিদ্রোহ। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন নদিয়া, যশােহর, চব্বিশ পরগনা, মালদহ, ঢাকা, রাজশাহি প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তারলাভ করে । তিতুমির মূর্তিপূজা, পিরদের পূজা ও সুদে টাকা খাটানাের বিরােধী ছিলেন।
বাংলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমন করতে উদ্যোগী হয়। 1831 খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। কামানের গােলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। তিতুমির এই অভিযানে প্রাণ হারান। গােলাম মাসুম ও অন্যান্য বন্দি সেনাদের ফাঁসি হয়়। ফলে এই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে তিতুমির স্তিমিত হয়ে পড়ে।
ওয়াহাবি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য
বৈশিষ্ট্য ঃ ও বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন
- ঔপনিবেশিক শশাষণের বিরুদ্ধে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।
- বহু নির্যাতিত হিন্দু এই আন্দোলনে যােগদান করেছিল । হিন্দু – মুসলিমের একত্রে যােগদান এই আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরে এটি আর্থসামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।
- এই আন্দোলনের আর – একটি বৈশিষ্ট্য হল , এটি মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।
- এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল।
- বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ।
- ধর্মীয় অনুপ্রেরণা এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি ছিল।
ওয়াহাবি আন্দোলন বিশ্লেষণ
বিশ্লেষণ ঃ মূল ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শ থেকে বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন পথভ্রষ্ট হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কারণ ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ভারতকে ইসলামের দেশ ( দার-উল-ইসলাম ) -এ পরিণত করতে গিয়ে বাংলার ওয়াহাবিরা জমিদার বিরােধী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। অভিজিৎ দত্ত বলেছেন যে, তিতুমিরের বারাসত
বিদ্রোহ ছিল আসলে অন্ধ মুসলিম জেহাদ। অন্যদিকে নরহরি কবিরাজ একে ধর্মের আবরণে মােড়া কৃষক বিদ্রোহ বলেছেন। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ বলেছেন যে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল নিম্নবর্গের মানুষের মর্যাদা রক্ষার রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু একই সঙ্গে এই আন্দোলন ভারতবর্ষের সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে আঘাত করে এবং মুসলিম, বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেয়়।
ওয়াহাবি আন্দোলন টুকরাে কথা
[su_note note_color=”#f7d630″ text_color=”#010916″]তরিকা-ই-মহম্মদিয়া। তিতুমির বাংলায় যে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন তার নাম তরিকা-ই-মহম্মদিয়া। এর অর্থ মহম্মদের পথ। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেন যে, তিতুমিরের অনুগামীরা নিজেদেরকে ‘হেদায়তী’ ( নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত ) এবং আন্দোলনকে তরিকা-ই-মহম্মদিয়া’ বলত। কিন্তু তিতুর আন্দোলনকে চলিত ভাষায় বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন বলা হয়। অধ্যাপক গৌতম ভদ্রের মতে, তিতুর সময় ওয়াহাবি নামটি প্রচলিত ছিল না। কলভিন একে ‘একদম স্থানীয় বলে উল্লেখ করেছেন। তিতুমিরের আন্দোলনের প্রকৃত নাম নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।[/su_note]
তিতুমিরের আন্দোল
- তরিকা – ই – মহম্মদিয়া।
- বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন।
- বারাসত বিদ্রোহ।
- ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কাণ্ড।