সূচনা : যে – কোনাে দেশের বিদেশনীতির পশ্চাতে থাকে সেই দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সুগভীর প্রভাব । ভারতের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযােজ্য । গৌতমবুদ্ধের শান্তির ললিত বাণী , অশােকের অহিংস বাণী , ভক্তি ও সুফিসাধকদের সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ স্বাধীন ভারতের বিদেশনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে । বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে জোটবদ্ধ রাজনীতির প্রাঙ্গণ থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে ভারত স্বাধীনভাবে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে ।
স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য :—
>> 1. জোটনিরপেক্ষতা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট এবং সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গড়ে ওঠে । ভারত এই দুই জোটের বাইরে থেকে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে ।
>> 2. স্বাধীন ও স্বতন্ত্র : স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে তা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র । প্রয়ােজনীয় সামরিক ও আর্থিক শক্তির অভাব থাকলেও ভারত কখনােই অন্যদেশের কাছ থেকে সমর ও অর্থসাহায্য নিয়ে অন্যের অনুসরণে বা অনুকরণে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেনি ।
>> 3. ঔপনিবেশিকতা বিরােধী : ভারত দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে স্বাধীন হয়েছে । তাইভারত পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম , নামিবিয়া , দক্ষিণ আফ্রিকা , কঙ্গের ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছে ।
>> 4. সাম্রাজ্যবাদবিরােধী : সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারত বরাবর প্রতিবাদে সােচ্চার । নিকারাগুয়া এল সালভাডাের , ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ , পানামায় বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে ভারতবর্ষ সর্বদা নিন্দা করে এসেছে । আবার এশিয়া , আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জাতীয় আন্দোলনের প্রতি ভারত সর্বদা সহানুভূতিশীল মনােভাব দেখিয়েছে । নামিবিয়ার জনগণের সংগ্রাম ও প্যালেস্টাইন মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামকে ভারত সমর্থন করেছে ।
>> 5. নয়া উপনিবেশবাদবিরােধী : সাম্রাজ্যবাদের নতুন রূপ নয়া উপনিবেশবাদ । রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন , সামরিক জোট গঠন , সামরিক ঘাঁটি স্থাপন , আর্থিক ও সামরিক সাহায্যদান , নাশকতামূলক কাজে গােপনে মদত দিয়ে এই শক্তি অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে চলেছে । ভারত সার্ক স্থাপন , আফ্রিকা তহবিল গঠন ইত্যাদির মাধ্যমে নয়া উপনিবেশবাদের বিরােধিতা করে । চলেছে ।
>> 6. বর্ণবৈষম্য বিরােধী : বিশ্বের সর্বত্রই শাসকশ্রেণি , শােষিত জাতির মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করে শাসনব্যবস্থা কায়েম রাখে । জাতি ও বর্ণের অজুহাতে শাসকশ্রেণি শােষিত ও শাসিত মানুষকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে । ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবিদ্বেষী নীতির বিরােধিতা করেছে । নির্জোট আন্দোলনে , কমনওয়েলথ সম্মেলনে এবং জাতিপুঞ্জে ভারত বর্ণবৈষম্যের বিরােধিতা করেছে ।
>> 7. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি : সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ভারতের বিদেশ নীতির অন্যতম অঙ্গ । ভারত চায় তার প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে কূটনৈতিক , বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে । ভারত বিশ্বাস করে যুদ্ধ বা সংঘাত নয় , শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে – কোনাে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব ।
>> ৪. নিরস্ত্রীকরণ নীতি : ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল নিরস্ত্রীকরণ ও আণবিক মারণাস্ত্রের প্রসার রােধ । ভারত চায় মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করার কাজে আণবিক শক্তি ব্যবহার করা হােক । সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত নিরস্ত্রীকরণের সপক্ষে মত প্রকাশ করেছে ।
>> 9. অহিংস আদর্শ : সম্রাট অশােক ও মহাত্মা গান্ধির আদর্শ অনুসরণে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অহিংসার আদর্শ গৃহীত হয়েছে । ভারত মনে করে হিংসার নীতি আরও বেশি করে হিংসার জন্ম দেয় এবং যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে । পৃথিবীতে দু – দুটি বিশ্বযুদ্ধ আসলে এই হিংসারই আমােঘ পরিণাম । তাই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্যই ভারত তার অহিংস আদর্শকে পররাষ্ট্রনীতির অঙ্গীভূত করেছে ।
স্বাধীনােত্তর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সার্থকতা
ভারতবর্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে তার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক সার্থকতা মিলেছে—
>> 1. কোরিয়া সমস্যায় : ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যেকার যুদ্ধ সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে ভারত সফল হয়েছে । এক্ষেত্রে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গগুলির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ভারত দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে । যুদ্ধবিরতির পর বন্দি – বিনিময় নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে ভারতের মধ্যস্থতায় জেনারেল থিমায়ার নেতৃত্বে কোরিয়া সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয় ।
>> 2. ভিয়েতনাম সমস্যায় : প্রথমে ইন্দোচিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতায় এবং পরে ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতায় গৌরবজনক ভূমিকা ছিল ভারতের । ১৯৫৪ খ্রি . জেনেভা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যে তিনটি কমিশন নিযুক্ত হয় , সেগুলির সভাপতি ছিলেন তিনজন ভারতীয় । এঁরা হলেন যথাক্রমে জে . এম . দেশাই , জে . এন . খােসলা এবং জে . পার্থসারথী প্রমুখ ।
>> 3. চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য মনােনয়নে : ১৯৪৯ খ্রি . চিন সাম্যবাদী প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় মার্কিন জোট চিনকে জাতিপুঞ্জের স্বীকৃতিতে বাধা দেয় । বিবাদ থাকা সত্ত্বেও চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ দেওয়ার লক্ষ্যে ভারত জোরালাে সমর্থন জানায় । অবশেষে কমিউনিস্ট চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ দেওয়া হয় এবং পরে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
>> 4. সুয়েজ সংকটের সমাধানে : ১৯৫৬ খ্রি . ২৬ জুলাই মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করলে সুয়েজ সংকটের সৃষ্টি হয় । ভারত এই সংকটের সমাধানে এগিয়ে আসে । লন্ডন সম্মেলনে ( ১৯৫৬ খ্রি . , আগস্ট ) ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশমন্ত্রী কৃয় মেনন পাঁচ দফা পরিকল্পনা পেশ করেন । তিনি সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলির মধ্যে এক কমিটি গঠন করে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কিছু পরামর্শ দেন । শেষপর্যন্ত ভারতের প্রচেষ্টাতেই সুয়েজ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয় ।
>> 5. তৃতীয় বিশ্বে নির্জোট আন্দোলনের সূচনা : এশিয়া , আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি নিয়ে গঠিত তৃতীয় বিশ্বে মূলত ভারতের নেতৃত্বেই নির্জোট আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে । স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে অনুষ্ঠিত ( ১৯৫৫ খ্রি . ) বান্দুং সম্মেলন থেকে এর সূচনা ঘটেছিল বলা চলে ।
আরো তথ্য জানার জন্যে আমাদের সাইটে জুড়ে থাকুন;… Kalikolom.com
Thanks