কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকরণ বিশ্লেষণ
উত্তর:- ভূমিকা : ভারতের স্বাধীনতালাভের প্রাক্কালে ৫৬২ টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিল এবং এগুলির অধিকাংশই ভারতে যোগ দিলেও কাশ্মীর এক দীর্ঘসূত্রী সমস্যার সৃষ্টি করে।
কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট : কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
হরি সিং-এর সিদ্ধান্ত : কাশ্মীর রাজ্য ছিল স্বাধীন এবং এই রাজ্যের রাজা হরি সিং ছিলেন হিন্দু, কিন্তু তার অধিকাংশ প্রজাই ছিল মুসলিম। হরি সিং প্রথমদিকে ভারত বা পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রেই যোগ না দিয়ে তার স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন।
পাকিস্তানের প্রচেষ্টা : রাজনৈতিক-ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কাশ্মীর খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্না কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হন।
শেখ আবদুল্লার ভূমিকা : কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
পাক-আক্রমণ : পাকিস্তানের মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে উরি, বারমুলা প্রভৃতি স্থান দখল করে (২২ অক্টোবর, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
উপসংহার : এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠালে ভারত সরকার মহারাজা হরি সিং-কে শর্ত দেন যে, তিনি যদি ভারতভুক্তি দলিলে স্বাক্ষর করেন তবেই ভারত সামরিক সাহায্য প্রদান করবে। এই অবস্থায় মহারাজা হরি সিং শর্তসাপেক্ষে ভারতে যোগদান করেন (২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)।
কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃতি ও প্রভাব আলোচনা করো।
ভূমিকা : ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সমস্যাবহুল দেশীয় রাজ্যটি হয় কাশ্মীর।
সমস্যার প্রকৃতি : প্রাথমিক পর্বে কাশ্মীর ভারতে যোগ দিতে না চাওয়ায় যে সমস্যা তৈরি হয় তা হল—
পাক-আক্রমণ : স্বাধীন রাজ্যরূপে কাশ্মীর রাজ্যের একটি ঐতিহ্য থাকায় কাশ্মীর রাজা হরি সিং ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চাইলেও পাক-মদতপুষ্ট হানাদারগণ কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত সরকার শর্তসাপেক্ষে হরি সিং-কে | আটক সামরিক সাহায্য করলে হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগ দেন (২৬ পাকি অক্টোবর, ১৯৪৭) খ্রিস্টাব্দ।
আজাদ কাশ্মীর :- কাশ্মীর রাজ্য হরি সিং-এর সামরিক সাহায্যের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কাশ্মীর থেকে পাক হানাদারদের বিতাড়ন করে। এরপর পাকিস্তান সুপরিকল্পিতভাবে ছদ্মবেশে পাক সেনাবাহিনীকে কাশ্মীরে প্রেরণ করলে ভারত-পাক যুদ্ধ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮) সম্পাদিত হয়। কিন্তু কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়ে যায়, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত।
প্ৰভাব : পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পরিপূর্ণভাবে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্যতম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। অন্যদিকে কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেরও সূচনা হয়। ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল।
কাশ্মীর বিতর্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর:- ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর দেশীয় রাজ্য কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে ভারতীয় সরকার এবং পাক-হানাদারদের নেতৃত্বে ‘আজাদ কাশ্মীর গঠিত হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের ভারতের অন্তর্গত কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভারত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের দ্বারস্থ হলে পাকিস্তান কাশ্মীরে গণভোটের দাবি জানায়। এই পরিস্থিতিতে জাতিপুঞ্জ কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ‘যুদ্ধবিরতি সীমারেখা‘ (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ খ্রি.) নির্ধারণ করে তা ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ বা LOC (Line of Control) নামে পরিচিত।
কাশ্মীর বিতর্ক ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ :- সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে কাশ্মীর প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হলে পাকিস্তান প্রথমে জানায় যে বেসরকারি হানাদার বাহিনী কর্তৃক কাশ্মীর আক্রমণ করার জন্য পাকিস্তানের কোনো দায়িত্ব নেই, পাকিস্তানকে এজন্য আক্রমণকারী বলা যাবে না।
ভারতের যুক্তি : ভারতের যুক্তি ছিল যেহেতু হানাদাররা পাকিস্তানে থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে, সেহেতু তাদের আটকানোর দায় ছিল পাকিস্তানের, এই দায়িত্ব পালন না করায় পাকিস্তান ছিল অপরাধী।
পাকিস্তানের পালটা যুক্তি : জাতিপুঞ্জে ভারতের উপস্থিত না হওয়ায় তারা পালটা যুক্তি করা যুক্তিগুলি পাকিস্তানের পছন্দ দেয় এবং গণভোট দাবি করে।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ভূমিকা :- আন্তর্জাতিক ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি নিলে ভারত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরাগভাজন হয়। সুতরাং জাতিপুঞ্জে পশ্চিমি শক্তিও প্রস্তাব পাস করে যে, কাশ্মীর সমস্যা গণভোটের দ্বারা সমাধান হবে। কাশ্মীরে গণভোটের জন্য অ্যাডমিরাল নিমিত্ত জাতিপুঞ্জের প্রতিনিধিরূপে নিযুক্ত হন।
উপসংহার : ভারত বাধ্য হয়ে দাবি করে যে, ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সেনা কাশ্মীর ত্যাগ করলে তবেই গণভোট সম্ভব। কিন্তু সেনা অপসারণের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা না হওয়ায় গণভোট স্থগিত ছিল। সমস্যার সমাধানের জন্য জাতিপুঞ্জ কমিশন পাঠালেও আজ পর্যন্ত তার কোনো সমাধান হয়নি।