ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। এই দুটি ধর্মের আবির্ভাব তখনকার সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, এবং ধর্মীয় জগতে এক বিশেষ পরিবর্তনের ফল। নিচে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থানের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হলো।
১. বৈদিক ধর্মের জটিলতা
তৎকালীন বৈদিক ধর্ম ছিল অত্যন্ত জটিল। ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন যজ্ঞ ও পূজা পরিচালনা করত যা সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা এবং পালন করা কঠিন ছিল। এছাড়াও, যজ্ঞ-সংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপগুলোর খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। এর ফলে সাধারণ মানুষ সহজ, সরল, এবং নৈতিক শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল, যা বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সরবরাহ করেছিল।
২. বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
তৎকালীন সমাজে বর্ণপ্রথা অত্যন্ত কড়াকড়ি ছিল। ব্রাহ্মণরা শাসকশ্রেণী হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকলেও শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের প্রতি সমাজের আচরণ ছিল নিষ্ঠুর। এই অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে বর্ণভেদের গুরুত্ব না থাকায় তা নিম্নবর্ণের মানুষদের আকৃষ্ট করেছিল।
৩. অর্থনৈতিক পরিবর্তন
ষষ্ঠ শতকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে কৃষি, বাণিজ্য ও নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়। ব্যবসায়ীরা একটি ধর্ম চেয়েছিল যা তাদের জন্য আরও সহায়ক হবে এবং যাগযজ্ঞে তাদের সম্পদ ব্যয় করতে হবে না। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এই চাহিদা পূরণ করেছিল।
৪. ধর্মীয় সংস্কারের প্রয়োজন
বৈদিক ধর্মের অন্তর্নিহিত দুর্নীতি ও অহংকার মানুষকে একটি নতুন নৈতিক এবং মানবিক ধর্মের দিকে ঠেলে দেয়। বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা ও দয়া এবং জৈন ধর্মের কঠোর তপস্যা ও আত্মসংযম এই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়।
৫. সহজ শিক্ষার প্রসার
গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর উভয়েই সাধারণ মানুষের ভাষায় তাদের শিক্ষা প্রদান করতেন। পালি এবং প্রাকৃত ভাষায় তাদের ধর্মীয় বার্তা ছড়িয়ে পড়ায় তা সহজেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
৬. রাজশক্তির সমর্থন
বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রে মগধের রাজা অশোক এবং জৈন ধর্মের ক্ষেত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সমর্থন প্রদান করেন। এই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় উভয় ধর্ম দ্রুত প্রসার লাভ করে।
৭. কৃষকদের জন্য গ্রহণযোগ্যতা
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম উভয়েই অহিংসার উপর গুরুত্বারোপ করেছিল, যা কৃষকদের জন্য আকর্ষণীয় ছিল। যাগযজ্ঞে পশুবলি প্রথার বিরোধিতা করার কারণে কৃষকেরা এই ধর্মগুলো গ্রহণ করে।
উপসংহার
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া ছিল যা ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ধর্মগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতীয় সমাজে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।