WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান | নারীর সামাজিক অবস্থান (Status of Women in Indian Society)



Digital বোর্ড: বিষয়বস্তু ✦ show

প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ

প্রাচীন কালের গ্রিস, রোম ও ভারতীয় সমাজে নারীরা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। তারা সর্বত্রই গৃহের কার্যে নিযুক্ত থাকত। আবার সমাজে পুরুষের সঙ্গে সমমর্যাদায় ধর্মচর্চা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করত। জিশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই গ্রিস বা রোমে নারীরা সাফল্যের সঙ্গে রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসেও মধ্যযুগে বিভিন্ন নারীর কৃতিত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যাবলি লক্ষ করা যায়। তবে প্রাচীনকালে ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে নারীরা যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল তা মূলত উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন দেশেই সমাজের নীচু স্তরে নারীদের মর্যাদা যথেষ্ট হ্রাস পেঁয়েছিল। অবশ্য মর্যাদার হ্রাস সত্ত্বেও সে যুগে নারীরা কিছু কিছু অধিকার ভোগ করত। তারা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেত, কিছু সম্পত্তির মালিক হতে পারত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের বিবাহের ক্ষেত্রে নিজেই পাত্র নির্বাচনের অধিকার পেত।

 

প্রাচীন ভারতে নারী শিক্ষা

প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতের নারীরা শিক্ষা গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল।
 

ঋক বৈদিক যুগে নারীদের অবস্থান কেমন ছিল

ঋগ্‌বৈদিক যুগে : 1. নারীর গুরুত্ব : ঋগ্‌বৈদিক যুগে (১৫০০-১০০০ খ্রি.পূ.) পরিবারের অধিকাংশ সদস্য পুত্রসন্তান কামনা করলেও নারীরা মোটেই অবহেলিত ছিল না।
2. নারী শিক্ষা : এ যুগের নারীরা শিক্ষাগ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ লাভ করেছিলেন। ঋগ্‌বৈদিক যুগের নারীদের শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মচর্চা, চরিত্র গঠন এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো। এ যুগে মমতা, ঘোষা, অপালা, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, বিশাখা প্রমুখ বিদুষী নারীর কথা জানা যায়।
3. বেদজ্ঞ নারী : এ যুগে বহু নারী বেদ পাঠের অধিকারী ছিলেন এবং বেদের স্তোত্র রচনায়ও অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
 

বৈদিক সমাজে নারীর অবস্থান

পরবর্তী বৈদিক যুগে : 1. নারীর মর্যাদা হ্রাস : পরবর্তী বৈদিক যুগে (১০০০-৬০০ খ্রি.পূ.) নারীর মর্যাদা হ্রাস পায় এবং নারী বেদ পাঠের অধিকার হারায়
2. শিক্ষা গ্রহণে বঞ্চনা : তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা হয়েছে যে, নারীর শিক্ষালাভের কোনো প্রয়োজন নেই। তা সত্ত্বেও এ যুগে নারীশিক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়নি। এসময় কোনো কোনো নারী উচ্চশিক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রমুখ ছিলেন এ যুগের বিদুষী নারী। পরবর্তী বৈদিক যুগে যে সকল নারী বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত বিদ্যাচর্চা করতেন তাঁদের বলা হত ‘সদ্যোদ্বাহা’। যে সকল নারী আজীবন অবিবাহিত থেকে ধর্ম ও দর্শন চর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন তাঁরা ‘ব্রহ্মবাদিনী’ নামে পরিচিত ছিলেন।
 

 

প্রতিবাদী আন্দোলনের যুগে :
মহাকাব্য ও প্রতিবাদী ধর্মের যুগে নারীশিক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়। মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পণ্ডিতা’ বলে উল্লেখ করার ঘটনা থেকে নারীর পাণ্ডিত্যের প্রমাণ মেলে। নারীরা এ যুগে সামরিক শিক্ষাও গ্রহণ করত বলে জানা যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ বিনয়পিটকে নারীদের বিদ্যার্জনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষিত বৌদ্ধ ভিক্ষুণীরা বিভিন্ন সংগীত রচনা করতেন যেগুলি থেরীগাথা গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ যুগের নারীরা সংস্কৃত কাব্য এবং নাটকও রচনা করতেন বলে জানা যায়। চন্দনা, জয়ন্তী প্রমুখ এ যুগের উচ্চশিক্ষিত নারী ছিলেন।

মৌর্য যুগে এবং আগে ও পরে :

প্রাক্-মৌর্য, মৌর্য ও মৌর্য-পরবর্তী যুগে নারীশিক্ষার অগ্রগতি ঘটে। এ যুগে অভিজাত নারীরা শিক্ষালাভের যথেষ্ট সুযোগ পেতেন। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে এ যুগের বেদজ্ঞা নারীর উল্লেখ আছে। কৌশাম্বীর রাজকন্যা আজীবন অবিবাহিতা থেকে বিদ্যাচর্চা করেছিলেন বলে জৈনশাস্ত্র থেকে জানা যায়। পাণিনি তাঁর গ্রন্থে ‘উপাধ্যায়া’ নামে নারী-শিক্ষিকার উল্লেখ করেছেন। কাত্যায়নের রচনায়ও অনুরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মৌর্য যুগে অভিজাত পরিবারের নারীরা শিক্ষিতা হলেও তাঁদের মধ্যে পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল। এ যুগের সংস্কৃত সাহিত্যে লেখাপড়া জানা, চিত্রশিল্পে দক্ষ এবং সংগীত রচয়িতা বহু নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। মৌর্য যুগে শিক্ষিতা নারীরা রাজকার্যেও অংশগ্রহণ করতেন।

গুপ্ত যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান :

নারীশিক্ষার বিষয়টি গুপ্ত যুগেও অব্যাহত ছিল। এ যুগের নারীদের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পেলেও তা তাদের শিক্ষালাভের অধিকারকে কেড়ে নেয়নি। গুপ্ত যুগের সাহিত্যে সমকালীন নারীদের ইতিহাস ও কাব্যচর্চর উল্লেখ আছে। বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্রে গুপ্ত যুগের উচ্চবংশজাত মহিলাদের শাস্ত্রচর্চা ও চৌষট্টি কলাবিদ্যার অনুশীলনের উল্লেখ করেছেন। শাস্ত্রজ্ঞান এ যুগের নারীর মেধাকে তীক্ষ্ণ করত বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। বাৎস্যায়ন বলেছেন যে, আদর্শ পত্নীকে সুশিক্ষিতা হতে হবে এবং তাকে বাৎসরিক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখতে হবে। তবে এ যুগে নারীশিক্ষায় যা কিছু অগ্রগতি ঘটেছিল তা সমাজের উচ্চস্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ দরিদ্র নারীদের শিক্ষার সুযোগ যথেষ্ট সংকুচিতই ছিল।

গুপ্ত-পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থান কেমন ছিল

গুপ্ত যুগের পরবর্তীকালে নারীশিক্ষা একইভাবে প্রচলিত ছিল। হর্ষবর্ধনের আমলে নারীরা নৃত্য, সংগীত, চিত্রকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষালাভ করতেন বলে জানা যায়। বাণভট্ট উল্লেখ করেছেন যে, হর্ষবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রী নৃত্য, সংগীত ও অন্যান্য কলার চর্চা করতেন। হর্ষবর্ধনের পরবর্তীকালেও নারীরা শিক্ষা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ভারতে তুর্কি আক্রমণ ও তার পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নারীশিক্ষার বিষয়টি কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছিল।

নারীর বিবাহরীতি

প্রাচীন ঋগ্‌বৈদিক যুগ থেকেই নারীসমাজে বিভিন্ন ধরনের বিবাহরীতির দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
  1. বিবাহিত নারী কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করা, স্বামীর সঙ্গে ধর্মচর্চায় অংশ নেওয়া বা সংস্কৃতিচর্চায় রত থাকলেও ভারতীয় সমাজে বিবাহিত নারীর প্রধান কর্তব্য ছিল সুন্দর ও সুশৃঙ্খল গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা করা।
  2. ঋগ্বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তী বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর বিবাহরীতি, বৈবাহিক জীবন ও গার্হস্থ্য জীবনে নানা বিবর্তন ঘটতে দেখা যায়।
  3. প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র ও অন্যান্য সাহিত্যগুলিতে নারীর বিবাহরীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন যুগে নারীর সামাজিক মর্যাদা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তার প্রভাব নারীর বিবাহরীতিতেও পড়তে দেখা গেছে।
  4. সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বিবাহরীতিতেও নারীর গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেয়েছে।

ঋগ্‌বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান কেমন ছিল

ঋগ্‌বৈদিক যুগে নারীর যথেষ্ট মর্যাদা ছিল। এ যুগে নারীর বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল না। এই সময় নারী নিজের পছন্দমতো পতি নির্বাচনের সুযোগও পেতেন। কোনো কোনো নারী আজীবন অবিবাহিত থেকে বিদ্যাচর্চা ও শাস্ত্রচর্চা করে জীবন কাটিয়ে দিতেন। এ যুগে প্রাক্-বিবাহ প্রেম ও অবৈধ প্রেমের প্রচলনও ছিল। প্রচলিত পণপ্রথা অনুসারে কন্যার পিতা পণ পাওয়ার অধিকারী ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিধবার পুনর্বিবাহ হত। সাধারণত বিধবা নারী তাঁর দেবরকে বিবাহ করতেন।



পরবর্তী বৈদিক যুগে

পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর বিবাহরীতি পূর্বাপেক্ষা কঠোর হয়। নারীর সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের প্রভাব তার বিবাহরীতিতেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এ যুগে নারীর বাল্যবিবাহ, বিধবাবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ প্রভৃতির প্রচলন নারীসমাজের সামাজিক মর্যাদা হ্রাসের প্রমাণ দেয়। এই সময় উচ্চ সম্প্রদায়, বিশেষ করে রাজপরিবার বা শাসক পরিবারে বহুবিবাহের প্রচলন ছিল। এ যুগে স্বগোত্রে বিবাহের প্রচলন ছিল না। তবে সবর্ণ এবং অসবর্ণ অর্থাৎ উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের বিবাহ প্রচলিত ছিল। অবশ্য একজন আর্য পুরুষ শূদ্র মহিলাকে বিবাহ করার অধিকারী হলেও কোনো আর্য নারীকে বিবাহ করার অধিকার একজন শুদ্র পুরুষের কখনোই ছিল না। অসবর্ণ বিবাহজাত সন্তান সাধারণত পিতার বর্ণ-পরিচয়ে পরিচিত হত।

মৌর্য যুণে নারীর অবস্থান কেমন ছিল

মৌর্য যুগে চারপ্রকার শাস্ত্রীয় অর্থাৎ বৈধ এবং চার প্রকার অশাস্ত্রীয় বিবাহরীতির প্রচলন ছিল। এ যুগে সতীদাহ প্রথাকন্যাপণের প্রচলন ছিল। নিজ জাতি ও নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন। স্বামী সন্ন্যাস নিলে বা নিরুদ্দেশ হলে নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারত”¹ বলে পরাশর সংহিতায় উল্লেখ করা হয়েছে। দাম্পত্য জীবনে উপযুক্ত কারণ থাকলে নারীরা তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতেও পারত। এ যুগে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল বলে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্রে এ যুগের আট প্রকার বিবাহরীতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল—
  1. ব্রাহ্ম : কোনো চরিত্রবান পাত্রকে আমন্ত্রণ করে তার হাতে পিতা কর্তৃক কন্যা-সম্প্রদান করার ঘটনাকে ব্রাহ্মবিবাহ বলা হত।
  2. দৈব :
  3. আর্য : পাত্রের কাছ থেকে এক জোড়া গাভি বা ষাঁড় নিয়ে পিতা কর্তৃক পাত্রকে কন্যা সম্প্রদান আর্য বিবাহ নামে পরিচিত।
  4. প্রাজাপত্য : পিতা স্বেচ্ছায় তাঁর নির্বাচিত পাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করলে তাকে প্রাজাপত্য বিবাহ বলে।
  5. অসুর : কন্যাপক্ষকে অর্থ দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করাকে অসুর বিবাহ বলে।
  6. গান্ধর্ব : অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় বিবাহ করলে তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলা হত।
  7. রাক্ষস : পাত্র জোর করে পাত্রীকে হরণ করে বিবাহ করলে তাকে রাক্ষস বিবাহ বলা হত।
  8. পৈশাচ : নিদ্রামগ্ন বা অচৈতন্য পাত্রীকে হরণ করে বিবাহ করার ঘটনা পৈশাচ বিবাহ নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, প্রথম পাঁচটি বিবাহরীতির ক্ষেত্রে সামাজিক অনুমোদন থাকলেও পরের তিনটির ক্ষেত্রে তা ছিল না।

মৌর্য-পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থান কেমন ছিল

মৌর্য-পরবর্তী যুগে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল।
  1. এ যুগের শাস্ত্রকার মনু বলেছেন যে, বিবাহিতা নারী তার স্বামীর উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য। তিনি মনে করতেন যে, “স্বামীর উচিত স্ত্রীকে সর্বদা সঙ্গদান করে রক্ষা করা, না হলে স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারিণী হতে পারে।” মনু আরও বলেছেন যে, নারী প্রথম জীবনে পিতার অধীনে, বিবাহিত জীবনে স্বামীর অধীনে এবং পরবর্তী জীবনে পুত্রের অধীনে বার্ধক্য জীবন কাটাবেন।
  2. এ যুগে ‘অনুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহরীতি প্রচলিত ছিল। উচ্চবর্ণের পুরুষ ও নিম্নবর্ণের নারীর মধ্যে সংঘটিত বিবাহ হল ‘অনুলোম’ বিবাহ। ‘প্রতিলোম’ হল নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর মধ্যে সংঘটিত বিবাহ।

গুপ্ত যুগে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল

গুপ্ত যুগে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন হত।
  1. এ যুগে সাধারণত চার প্রকার বিবাহরীতির বহুল প্রচলন ছিল—ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য বিবাহ। তবে রাজপরিবারে পাত্রপাত্রীর নিজের পছন্দে অর্থাৎ গান্ধর্ব বিবাহের প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজকন্যার বিবাহের জন্য পিতা স্বয়ংবর সভার আয়োজন করতেন বলেও জানা যায়।
  2. এ যুগে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রাপ্ত বয়স্ক উভয় প্রকার নারীর বিবাহের প্রথাই প্রচলিত ছিল। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিবাহের উল্লেখ আছে।
  3. এ যুগের বিবাহে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহরীতি এবং পুরুষের একাধিক পত্নী গ্রহণের প্রথা প্রচলিত ছিল। এ যুগের ব্রাক্ষ্মণ বাকাটক রাজবংশের সঙ্গে অন্য বর্ণের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়
  4.  তবে স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বলে হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছেন।

গুপ্ত-পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থান

  1. গুপ্ত-পরবর্তী যুগে সাধারণত মেয়েদের বয়স ১২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহ দেওয়া হত। নারীর বিবাহের বয়স প্রসঙ্গে হরিভদ্র তাঁর ধর্মবিন্দু গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বিবাহের সময় ছেলেদের বয়স ২৬ এবং মেয়েদের বয়স ১২ বছর হওয়া উচিত।
  2. এ যুগে রাষ্ট্রকূট রাজবংশের নারীরা স্বয়ংবর সভার মাধ্যমে পতি নির্বাচনের স্বাধীনতা পেত।
  3. গুর্জর প্রতিহার সমাজে সাধারণত সবর্ণে নারীদের বিবাহ হত। তবে সগোত্রে বিবাহ প্রচলিত ছিল না।
  4. পরবর্তীকালে পাল ও সেন যুগে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সবর্ণ বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ প্রভৃতির প্রচলন ছিল। সেন যুগে নারীর বাল্যবিবাহের বহুল প্রচলন ছিল।
  5. বিবাহে যৌতুকপ্রথাকৌলীন্যপ্রথার প্রকোপ বেড়েছিল। কৌলীন্যপ্রথার ফলে পুরুষের বহুবিবাহের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
  6. সুলতানি আমলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজের মেয়েদেরই কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হত। বহু ক্ষেত্রে তুর্কি মুসলিম অভিজাতরা হিন্দু নারীকে বিবাহ করত।

নারীর গার্হস্থ্য জীবন

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণ, সংস্কৃতিচর্চা প্রভৃতির সুযোগ পেত। তবে পরিবারের অন্দরমহলে গার্হস্থ্য জীবন পরিচালনা করাই ছিল তাদের প্রধান কর্তব্য। নারী যুগে যুগে নিষ্ঠার সঙ্গে তার এই সামাজিক কর্তব্য পালন করে গেছে।

ঋগ্‌বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান

ঋগ্‌বৈদিক যুগে নারী পরিবারের গার্হস্থ্যকর্ম পরিচালনায় একাধিপত্য ভোগ করতেন।
  1. নারীই পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাতেন। গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, উদ্যানের পরিচর্যা করা, দাসদাসীদের কাজের তদারকি করা, সংসারের দৈনিক ও বার্ষিক আয়ব্যয়ের হিসাব রাখা প্রভৃতি দায়িত্ব পরিবারের গৃহিণীকে পালন করতে হত।
  2. তিনবেলা গৃহদেবতার পুজো করা, ব্রত উদ্‌যাপন, উপবাস প্রভৃতি কাজ বিবাহিতা নারীকেই করতে হত।
  3. নারী তার স্বামীর পরিবারে স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির নির্দেশ মেনে চলতেন এবং তাঁদের সেবা করতেন।
  4. বিশেষ প্রয়োজনে স্বামী বাড়ির বাইরে থাকলে স্ত্রীকে সংযত জীবনযাপন করতে হত।

পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অবস্থান

ঋগ্‌বৈদিক যুগে নারীর যেরূপ গার্হস্থ্য ভূমিকা ছিল তা পরবর্তী বৈদিক যুগেও মোটামুটি অব্যাহত ছিল।
  1. তবে এ যুগে সাধারণভাবে নারীর সামাজিক মর্যাদা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল নারীর পারিবারিক ও গার্হস্থ্য জীবনেও।
  2. ঐতরেয় ব্রাহ্মণএ কন্যাকে পরিবারে পিতামাতার দুঃখের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার ‘মৈত্রায়নী সংহিতায় নারী, সুরা ও পাশাকে একই পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে।
  3. বৌধায়ন ধর্মসূত্রে নারীর স্বাধীন সত্তাকে অস্বীকার করে বলা হয়েছে যে, নারী বাল্যে পিতার অধীনে, যৌবনে স্বামীর অধীনে এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে আরও বলা হয়েছে যে, বন্ধ্যা স্ত্রীকে বিবাহের দশ বছর পর এবং কেবলমাত্র কন্যাসন্তানের জন্মদাত্রী স্ত্রীকে বিবাহের বারো বছরের মধ্যে পরিত্যাগ করা যাবে।
  4. পরবর্তী মহাকাব্যের যুগেও গার্হস্থ্যকর্মে আবদ্ধ নারীর জীবনের উল্লেখ আছে। মহাভারতের বনপর্বে এই বিধান রয়েছে যে, যজ্ঞানুষ্ঠান, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, ব্রত উপবাস ইত্যাদির দ্বারা নয়, কেবল স্বামী সেবার দ্বারা নারীরা স্বর্গ লাভ করতে পারে।

মৌর্য ও মৌর্য-পরবর্তী যুগে নারী অবস্থান

  1.  মৌর্য যুগে নারী গার্হস্থ্য পরিচালনার পাশাপাশি নৃত্য, সংগীত, হস্তশিল্পকর্ম প্রভৃতির চর্চাও করত। গৃহে আগত অতিথির সেবা-যত্ন করা নারীর প্রধান কর্তব্য ছিল। নারী গৃহকর্ম সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করতেন। তবে পারিবারিক জীবনে নারীর অবস্থান নির্ধারণ করতে গিয়ে শাস্ত্রকার মনু বৌধায়ন ধর্মসূত্রের অনুসরণে নারীকে বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন বলে অভিহিত করেছেন।
  2. মৌর্য-পরবর্তী যুগে স্ত্রীকে গৃহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির সেবা-যত্ন, দাসদাসীদের কাজের তদারকি প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করতে হত। মনু বলেছেন যে, স্ত্রীকে রক্ষার একমাত্র উপায় হল সর্বদা গার্হস্থ্য কর্মে নিযুক্ত রাখা।

গুপ্ত যুগে নারীর অবস্থান

  1. গুপ্ত যুগে পরিবারের অন্দরে কর্তৃত্বের দায়িত্ব ছিল গৃহকর্ত্রীর। গুপ্ত যুগের লেখক কালিদাস তাঁর অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ নাটকে উল্লেখ করেছেন যে, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রাকালে মহর্ষি কম্ব তাকে গুরুজনদের সেবা করতে, দাসদাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে, স্বামী মেজাজ হারালেও তার প্রতি বাধ্য থাকতে উপদেশ দেন।
  2. বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন যে, এ যুগের গৃহিণীদের পরিবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা, গবাদিপশুর দেখাশোনা, গুরুজনদের সেবা, স্বামীর বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন, ভৃত্যদের পরিচালনা, সুতো কাটা, কাপড় বোনা প্রভৃতি কাজ করতে হত। প্রতিদিনের সাংসারিক খরচের হিসেব রাখার জন্য নারীকে গণিতের প্রাথমিক জ্ঞান রাখার কথাও শাস্ত্রে বলা হয়েছে।

গুপ্ত-পরবর্তী যুগে নারীর অবস্থান

গুপ্ত যুগের পর ভারতীয় সমাজে নারীর গার্হস্থ্য জীবন মোটামুটি একই ধরনের ছিল।
  1. বিভিন্ন শাস্ত্রকারদের নানা সামাজিক বিধিনিষেধের ফলে এ যুগে নারী গৃহের অন্দরে আরও বেশি করে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বহির্জগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন থেকে পরিবারের অন্দরমহলে গৃহের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করা, পরিবারের গুরুজনদের সেবা করা, সন্তানের দেখাশোনা করা, গৃহদেবতার পুজো করা প্রভৃতিতে নিয়োজিত থেকেই নারীকে জীবন অতিবাহিত করতে হত।
  2. পরবর্তী আদি-মধ্য যুগে (৬৫০ ১২০০ খ্রি.) হিন্দু নারীদের পরিবারের অন্দরে বন্দি হওয়ার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাইরের সমাজে তাদের যাতায়াত ও মেলামেশার অধিকার ছিল না। পতিব্রতা হয়ে স্বামীর দেখাশোনা করাই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। এজন্য সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে একাদশ শতকের ভারতবর্ষ ছিল হিন্দু ভারতবর্ষ, যেখানে শূদ্র ও নারী ছিল একেবারে নীচুতলার বাসিন্দা।”

 

About the Author

Aftab Rahaman

AFTAB RAHAMAN

I am Aftab Rahaman, the founder of KaliKolom.com. For over 10 years, I have been writing simple and informative articles on current affairs, history, and competitive exam preparation for students. My goal is not just studying, but making the process of learning enjoyable. I hope my writing inspires you on your journey to knowledge.

📌 Follow me: