ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
>> সূচনা : ভারতে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তােলার যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল , তার চরম পরিণতি হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরপ্রতিষ্ঠা । ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর বােম্বাইয়ের গােকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ ভবনে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক উদবােধন হয় । ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৭২ জন প্রতিনিধি জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলনে মিলিত হন । এই সম্মেলনে সভাপতিত করেন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।
অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম
প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বিভিন্ন মত : জাতীয় কংগ্রেসের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন , তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে । (1) পট্টভি সীতারামাইয়ার মতে , “ কে প্রথম সর্বভারতীয়” কংগ্রেস । প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেন , তা রহস্যাবৃত । (2) চরমপন্থী নেতা লালা লাজপত রায় ‘ Young India ‘ পত্রিকায় লিখেছেন , “ কংগ্রেস ছিল ডাফরিনের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা ” ( Congress was a product of Dufferin’s brain . ) । (3) আবার অ্যানি বেসান্ত দাবি করেছেন , “ ১৮৮৪ – তে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত থিয়ােজফিস্ট সম্মেলনেই এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা করা হয়েছিল । ”
* 2. প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা : (1) হিউমের ভূমিকা : পটুভি সীতারামাইয়া , হিউমের জীবনীকার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন , মার্কসবাদী লেখক রজনী পামদত্ত প্রমুখ জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কৃতিত্ব দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম – কে । তাঁদের মতে হিউম ভারতবাসীর প্রতি দরদি ও সহানুভূতিশীল ছিলেন । ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ হিউম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশে একটি খােলা চিঠি প্রকাশ করেন । এই চিঠিতে তিনি যুবসমাজকে দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নের কাজে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান । ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে হিউম বড়োেলাট লর্ড ডাফরিনের সঙ্গে দেখা করে একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার প্রস্তাব দেন । ড . নিমাইসাধন বসুও মন্তব্য করেছেন , “ জাতীয় কংগ্রেসের সংগঠনের কৃতিত্ব হিউমের পাওয়া উচিত ” ( The credit of organising the Indian National Congress belongs to A. 0. Hume ) । (2) সুরেন্দ্রনাথের ভূমিকা : রাজনৈতিক সংগঠন স্থাপন দ্বারা ভারতীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে সুরেন্দ্রনাথের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না । তিনি ভারতসভা গঠন করে সারা ভারতব্যাপী ব্রিটিশ – বিরােধী জনমত গড়ে তােলেন । জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে ভারতীয়দের একই সংস্থার পতাকাতলে সমবেতকরতে প্রয়াসী হন । অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে , “ জাতীয় সম্মেলন ছিল জাতীয় কংগ্রেসের মহড়াবিশেষ । ” (3) লর্ড ডাফরিনের ভূমিকা : উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে , এটি অনেকের কাছেই একটি সংবাদ হবে যে , জাতীয় কংগ্রেসের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লর্ড ডাফরিন । কেমব্রিজের ইতিহাসবিদ অনিল শীল অবশ্য সমালােচনা করে বলেছেন , জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় ডাফরিনের ভূমিকা অতিকথন । লালা লাজপত রায় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় ডাফরিনের অবদান স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন , ডাফরিনের মস্তিষ্ক থেকেই কংগ্রেসের জন্ম ।
3. প্রতিষ্ঠার উপাদান : (1) মূল উপাদান — সেটি ভাল তত্ত্ব : ইতিহাসবিদ রজনী পামদত্ত প্রমুখের মতে , ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে ‘ সেফটি ভালব ’ বা ‘ নিরাপদ নিয়ামকের কাজ করার জন্যই কংগ্রেস গঠিত হয়েছিল । হিউমের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষজনিত বিক্ষোভের কবল থেকে ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করা । কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে , দেশের নিম্নশ্রেণির লােকেরা ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে – কোনাে সময়ে বিদ্রোহ করতে পারে । তাই তিনি চেয়েছিলেন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে দেশের প্রগতিশীল অংশকে এই বিদ্রোহথেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে । ব্রিটিশের স্বার্থেই হিউম সেফটি ভাল বা ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরােধক হিসেবে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন । তাই বলা যায় , সেটি ভাস্ক তত্ত্বই ছিল জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মূল উপাদান । (2) অন্যান্য উপাদান : ( i ) উনিশ শতকের জাগরণ : উনিশ শতকে ভারতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের সূত্রে ধর্ম ও সংস্কৃতিতে যে নবজাগরণ দেখা যায় তা ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনা বাড়ায় । ( ii) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় ভারতের মুক্তিসংগ্রামের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে । ( iii ) ব্রিটিশের শশাষণ : ব্রিটিশের শােষণে ক্রমাগত শােষিত হয়ে শিক্ষিত ভারতবাসী অনুভব করে যে , এই শােষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং নিজেদের অধিকার ও দাবিগুলিকে আদায় করার জন্য এক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা প্রয়ােজন ।
মূল্যায়ন: প্রকৃত অর্থে উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতের রাজনৈতিক জাগরণের চূড়ান্ত ফলশ্রুতি ছিল জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা । ড . তারাচাঁদের মতে , “ কংগ্রেস ছিল দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ” ( Congress was the expression of the hope and aspirations of the people.) ।