ইসলামিক সম্পত্তি আইন বা ফারায়েজ হলো ইসলামী শরিয়াহর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সুবিচারপূর্ণভাবে বণ্টনের নিয়ম নির্ধারণ করে। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে গঠিত এই আইন মুসলিম সমাজে সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে অনন্য ভূমিকা রাখে। এই নিবন্ধে ইসলামিক সম্পত্তি আইনের মৌলিক নীতিমালা, বণ্টন পদ্ধতি, সংশ্লিষ্ট আইন ও বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ইসলামিক সম্পত্তি আইনের ভিত্তি ও বৈশিষ্ট্য
১. কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা: সূরা নিসার ১১ ও ১২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা সম্পত্তি বণ্টনের স্পষ্ট নীতিমালা উল্লেখ করেছেন । যেমন, পুত্র কন্যার অংশের অনুপাত ২:১, স্ত্রী/স্বামীর নির্দিষ্ট অংশ, এবং পিতা-মাতার অধিকার।
২. ফারায়েজের সংজ্ঞা: ফারায়েজ শব্দটি আরবি ‘ফারিদাহ’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বাধ্যতামূলক অংশ। এটি মৃতের দাফন-কাফন, ঋণ পরিশোধ, ও উইল কার্যকর করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তির বণ্টন প্রক্রিয়াকে বোঝায় ।
৩. উত্তরাধিকারের শ্রেণীবিভাগ:
- শেয়ারার (নির্দিষ্টাংশভোগী): ১২ জন প্রাথমিক উত্তরাধিকারী (যেমন: স্বামী, স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা) ।
- আসাবা (অবশিষ্টাংশভোগী): যারা শেয়ারারদের পর অবশিষ্ট সম্পত্তি পায় (যেমন: ছেলে, ভাই) ।
- দূরবর্তী আত্মীয়: শেয়ারার ও আসাবা অনুপস্থিতিতে সম্পত্তি প্রাপ্তি ।
সম্পত্তি বণ্টনের পূর্বশর্ত
বণ্টনের আগে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি অগ্রাধিকার পাবে:
১. দাফন-কাফনের খরচ: মৃতের সম্পত্তি থেকে প্রথমে দাফন-কাফনের ব্যয় মেটাতে হবে।
২. ঋণ পরিশোধ: জীবিতকালের যেকোনো ধার-দেনা পরিশোধ করতে হবে।
৩. দেনমোহর পরিশোধ: স্ত্রীর বাকি দেনমোহর থাকলে তা আদায় করতে হবে।
৪. উইল বাস্তবায়ন: মৃত ব্যক্তির বৈধ উইল থাকলে তা কার্যকর করা হবে (সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তিতে সীমাবদ্ধ) ।
প্রধান উত্তরাধিকারীদের অংশ
১. পুত্র-কন্যার অংশ:
- একমাত্র কন্যা: ১/২ অংশ।
- একাধিক কন্যা: ২/৩ অংশ (সমান হারে)।
- পুত্র-কন্যা একত্রে: পুত্র কন্যার দ্বিগুণ পায় (অনুপাত ২:১)।
- পুত্রের অনুপস্থিতিতে: কন্যা বা পুত্রের সন্তানেরা আসাবা হিসেবে সম্পত্তি পাবে।
২. স্ত্রী/স্বামীর অংশ:
- স্ত্রীর অংশ: স্বামীর সম্পত্তিতে সন্তান থাকলে ১/৮, না থাকলে ১/৪।
- স্বামীর অংশ: স্ত্রীর সম্পত্তিতে সন্তান থাকলে ১/৪, না থাকলে ১/২।
৩. পিতা-মাতার অংশ:
- পিতা: সন্তান থাকলে ১/৬; সন্তান না থাকলে আসাবা হিসেবে সম্পূর্ণ অবশিষ্টাংশ ।
- মাতা: সন্তান বা ভাইবোন থাকলে ১/৬; না থাকলে ১/৩ ।
৪. অন্যান্য আত্মীয়:
- দাদা/নানী: নির্দিষ্ট শর্তে ১/৬ অংশ ।
- ভাই-বোন: বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাইবোনের অংশ শর্তসাপেক্ষ ।
ইসলামিক আইন vs. অন্যান্য ধর্মীয় আইন
- হিন্দু উত্তরাধিকার আইন: ২০০৫ সালের সংশোধনী অনুযায়ী কন্যারা যৌথ সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায়।
- খ্রিস্টান আইন: উইল ছাড়া মৃতের সম্পত্তি স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে বণ্টিত হয়।
- বৌদ্ধ আইন: ভারতে প্রযোজ্য Indian Succession Act, 1925 অনুসরণ করা হয়।
সাধারণ ভুল ধারণা ও সমাধান
১. মেয়েরা কম পায়: ইসলামে কন্যাদের অংশ পুত্রের অর্ধেক হলেও তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় না ।
২. উইলের অপব্যবহার: উইলের মাধ্যমে সন্তানদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা যায় না ।
৩. সৎ সম্পর্ক: সৎ বাবা-মা বা সন্তানেরা সাধারণত উত্তরাধিকার পায় না ।
বাংলাদেশে ইসলামিক সম্পত্তি আইনের প্রয়োগ
- প্রাসঙ্গিক আইন:
- মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাক্ট, ১৯৩৭ ।
- মুসলিম ফ্যামিলি ল অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১ (উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কিছু সংশোধনী সহ) ।
- আদালতের ভূমিকা: শরিয়াহ আইনের পাশাপাশি বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে ।
FAQs: ইসলামিক সম্পত্তি আইন
Q: জারজ সন্তান কি সম্পত্তি পাবে?
A: না, জারজ সন্তান শুধুমাত্র মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার পায় ।
Q: হত্যাকারী কি উত্তরাধিকারী হতে পারবে?
A: না, হত্যাকারী সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত।
Q: অমুসলিম আত্মীয় কি সম্পত্তি পাবে?
A: ইসলামিক আইন অনুযায়ী অমুসলিমরা মুসলিমের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না ।
উপসংহার
ইসলামিক সম্পত্তি আইন একটি সুপরিকল্পিত ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা, যা পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সহায়ক। তবে বাস্তব প্রয়োগে আইনী জ্ঞান ও সচেতনতা অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শরিয়াহ আইনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইনের সমন্বয় প্রয়োজন। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে উকিল বা ফারায়েজ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উত্তম ।
সূত্র: উল্লিখিত ওয়েবপেজসমূহের আলোকে প্রস্তুত। বিস্তারিত জানতে তাহমিদুর রহমানের ব্লগ বা Lawyers Club Bangladesh ভিজিট করুন।