
বাংলাদেশে হিন্দু বিধবা নারীদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও আইনি জটিলতার অবসান ঘটিয়ে ২০২০ সালে হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় প্রকাশিত হয়। এই রায়ে হিন্দু বিধবারা স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি—বসতভিটা, কৃষিজমি, নগদ টাকা, বা অন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে সমান ভাগ পাবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয় । যদিও “হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইন ২০২০” নামে কোনো পৃথক গেজেট প্রকাশিত হয়নি, তবে ১৯৩৭ সালের হিন্দু উইমেন্স রাইটস টু প্রোপার্টি অ্যাক্ট-এর ব্যাখ্যা সম্প্রসারিত করে এই রায়টি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। Also Read – শত্রু সম্পত্তি আইন
ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা
১. ১৯৩৭ সালের আইনের সীমাবদ্ধতা
১৯৩৭ সালের আইন অনুযায়ী, হিন্দু বিধবা নারীরা স্বামীর বসতভিটার মালিকানা পেলেও কৃষিজমি বা অন্যান্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতেন। এই আইনে “সম্পত্তি” শব্দের সংজ্ঞা অস্পষ্ট থাকায় আদালতগুলো কৃষিজমিকে আলাদা করে বিচার করত ।
২. ২০২০ সালের রায়ের পটভূমি
খুলনার বটিয়াঘাটার গৌরী দাসীর মামলা এই পরিবর্তনের সূত্রপাত করে। ১৯৯৬ সালে তার দেবর জ্যোতিন্দ্রনাথ মণ্ডল কৃষিজমির অধিকার নিয়ে মামলা করলে নিম্ন আদালত গৌরীকে কৃষিজমি থেকে বঞ্চিত করে। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে জজ আদালত এবং ২০২০ সালে হাইকোর্ট রায় দেন যে, হিন্দু বিধবারা স্বামীর সব ধরনের সম্পত্তি পাবেন ।
২০২০ সালের রায়ের মূল বিষয়বস্তু
১. সম্পত্তির সংজ্ঞার সম্প্রসারণ:
- “সম্পত্তি” বলতে বসতভিটা, কৃষিজমি, নগদ টাকা, বা অন্য কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিকে বোঝানো হয়েছে।
- কৃষিজমি ও বসতভিটার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যাবে না।
২. দায়ভাগা পদ্ধতির প্রয়োগ:
- বাংলাদেশে প্রচলিত দায়ভাগা পদ্ধতি অনুযায়ী, স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী শ্বশুরের সম্পত্তিতে পুত্রের সমান অধিকার পাবেন ।
৩. ১৯৩৭ সালের আইনের পুনর্ব্যাখ্যা:
- হাইকোর্ট স্পষ্ট করে যে, ১৯৩৭ সালের আইনের ৩(১) ধারা অনুসারে বিধবা নারীরা শ্বশুরের সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।
এই রায়ের সামাজিক ও আইনি প্রভাব
১. নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা:
- বিধবা নারীরা এখন শুধু বসতভিটায় সীমিত নন; কৃষিজমির মালিকানা তাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে ।
২. সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ:
- আন্দোলনকারী দিপালী চক্রবর্তীর মতে, “এই রায় শতাব্দীর বৈষম্যের বেড়াজাল ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ” ।
৩. আইনি মর্যাদার স্বীকৃতি:
- বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও হিন্দু নারীরা দীর্ঘকাল এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন ।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
১. আইনের বাস্তবায়ন:
- আদালতের রায় আইনে রূপান্তরিত করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমানে হিন্দু আইন এখনও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অপরিবর্তিত ।
২. সামাজিক প্রতিবন্ধকতা:
- পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিরোধ এখনও প্রধান চ্যালেঞ্জ ।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি:
- হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি ।
উপসংহার
২০২০ সালের হাইকোর্টের রায় হিন্দু বিধবা নারীদের সম্পত্তির অধিকারে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। যদিও এই রায়কে “হিন্দু বিধবা সম্পত্তি আইন ২০২০ গেজেট” হিসেবে অভিহিত করা যায় না, তবে এটি ১৯৩৭ সালের আইনের একটি প্রগতিশীল ব্যাখ্যা। সরকার যদি এই রায়কে আইনি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে, তবে হিন্দু নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবেন—যা বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ।
সূত্রসমূহ: