WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা – সঞ্চয়িতা থেকে সব কবিতা| Poetry of Rabindranath Tagore’s all poetry in Bengali.



প্রিয় দর্শক, আজকে তোমাদের সাথে শেয়ার করলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলি ‘ সঞ্চয়িতা ‘ থেকে এইখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান প্রধান কবিতাগুলি আছে।খুব শীগ্রই আসছে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ২৫’ শে বৈশাখ ইংরেজি 9 may এই কবিতাগুলি তোমাদের অংশগ্রহনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিতা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা – সঞ্চয়িতা থেকে সব কবিতা| Poetry of Rabindranath Tagore’s all poetry in Bengali.

স্বপ্নে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুন্দর, তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে অরুণবরন পারিজাত লয়ে হাতে। নিদ্রিত পুরী, পথিক ছিল না পথে, একা চলি গেলে তোমার সোনার রথে- বারেক থামিয়া, মোর বাতায়নপানে চেয়েছিলে তব করুণ নয়নপাতে।

স্বপন আমার ভরেছিল কোন্ গন্ধে, ঘরের আঁধার কেঁপেছিল কী আনন্দে, ধুলায়-লুটানো নীরব আমার বীণা বেজে উঠেছিল অনাহত কী আঘাতে।

কতবার আমি ভেবেছিনু, ‘উঠি উঠি, আলস ত্যজিয়া পথে বাহিরাই ছুটি।’ উঠিন যখন তখন গিয়েছ চলে- দেখা বুঝি আর হল না তোমার সাথে।

 

সহযাত্রী– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনধরিয়া

১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৭

কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে, ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী কোথায় যেতেছি কোন্ দেশে সে কোন দেশে। কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে শোনাব গান একলা তোমার কানে, ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা আমার সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।

আজও সময় হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি- ওগো, ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে। মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি আপন কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে। কখন তুমি আসবে ঘাটের ‘ পরে বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে। অস্তরবির শেষ আলোটির মতো নিশীথ-মাঝে যাবে নিরুদ্দেশে। তরী

 

 বর্ষার রূপ–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বরষার রূপ হেরি মানবের মাঝে- চলেছে গরজি, চলেছে নিবিড় সাজে। হৃদয়ে তাহার নাচিয়া উঠিছে ভীমা, ধাইতে ধাইতে লোপ ক’রে চলে সীমা, কোন্ তাড়নায় মেঘের সহিত মেঘে বক্ষে বক্ষে মিলিয়া বজ্র বাজে।

পুঞ্জে পুঞ্জে দূর সুদূরের পানে দলে দলে চলে, কেন চলে নাহি জানে। জানে না কিছুই কোন্ মহাদ্রিতলে গভীর শ্রাবণে গলিয়া পড়িবে জলে; নাহি জানে তার ঘনঘোর সমারোহে কোন্ সে ভীষণ জীবন মরণ রাজে।

ঈশান কোণেতে ওই-যে ঝড়ের বাণী গুরুগুরু রবে কী করিছে কানাকানি!

দিগন্তরালে কোন্ ভবিতব্যতা স্তব্ধ তিমিরে বহে ভাষাহীন ব্যথা, কালো কল্পনা নিবিড় ছায়ার তলে ঘনায়ে উঠিছে কোন্ আসন্ন কাজে।

 

কৃপণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি,

ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে, তুমি তখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে। অপূর্ব এক স্বপ্নসম লাগতেছিল চক্ষে মম- কী বিচিত্র শোভা তোমার, কী বিচিত্র সাজ। আমি মনে ভাবতেছিলেম এ কোন্ মহারাজ ।।

আজি,

শুভক্ষণে রাত পোহালো, ভেবেছিলেম তবে আজ আমারে দ্বারে দ্বারে ফিরতে নাহি হবে। বাহির হতে নাহি হতে কাহার দেখা পেলেম পথে, চলিতে রথ ধনধান্য ছড়াবে দুই ধারে- মুঠা মুঠা কুড়িয়ে নেব, নেব ভারে ভারে।

দেখি,

সহসা রথ থেমে গেল আমার কাছে এসে, আমার মুখ-পানে চেয়ে নামলে তুমি হেসে। দেখে মুখের প্রসন্নতা জুড়িয়ে গেল সকল ব্যথা, হেনকালে কিসের লাগি তুমি অকস্মাৎ ‘আমায় কিছু দাও গো’ ব’লে বাড়িয়ে দিলে হাত।

মরি,

এ কী কথা রাজাধিরাজ, ‘আমায় দাও গো কিছু’- শুনে ক্ষণকালের তরে রইনু মাথা-নিচু। তোমার কিবা অভাব আছে ভিখারি ভিক্ষুকের কাছে! এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা। ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা।

যবে,

পাত্রখানি ঘরে এনে উজাড় করি- একি, ভিক্ষা-মাঝে একটি ছোটো সোনার কণা দেখি! দিলেম যা রাজ-ভিখারিরে স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে- তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভ’রে, তোমায় কেন দিই নি আমার সকল শূন্য করে?।

 

কুয়ার ধারে –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমার কাছে চাই নি কিছু, জানাই নি মোর নাম, তুমি যখন বিদায় নিলে নীরব রহিলাম। একলা ছিলেম কুয়ার ধারে নিমের ছায়াতলে, কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে। আমায় তারা ডেকে গেল, ‘আয় গো বেলা যায়।’ কোন্ আলসে রইনু বসে কিসের ভাবনায়।

পদধ্বনি শুনি নাইকো কখন তুমি এলে। কইলে কথা ক্লান্তকণ্ঠে- করুণ চক্ষু মেলে- ‘তৃষাকাতর পান্থ আমি।’ শুনে চমকে উঠে জলের ধারা দিলেম ঢেলে তোমার করপুটে। মর্মরিয়া কাঁপে পাতা, কোকিল কোথা ডাকে- বাবলা ফুলের গন্ধ ওঠে পল্লীপথের বাঁকে।॥

যখন তুমি শুধালে নাম পেলেম বড়ো লাজ- তোমার মনে থাকার মতো করেছি কোন্ কাজ! তোমায় দিতে পেরেছিলেম একটু তৃষার জল, এই কথাটি আমার মনে রহিল সম্বল। কুয়ার ধারে দুপুরবেলা তেমনি ডাকে পাখি, তেমনি কাঁপে নিমের পাতা- আমি বসেই থাকি ।।

 

পরিচয় – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একটি মেয়ে আছে জানি, পল্লিটি তার দখলে- সবাই তারি পুজো জোগায়, লক্ষ্মী বলে সকলে।

আমি কিন্তু বলি তোমায় কথায় যদি মন দেহ, খুব যে উনি লক্ষ্মী মেয়ে আছে আমার সন্দেহ।

ভোরের বেলা আঁধার থাকে, ঘুম যে কোথা ছোটে ওর- বিছানাতে হুলুস্থুলু কলরবের চোটে ওর।

খিল্ল্থিলিয়ে হাসে শুধু পাড়াসুদ্ধ জাগিয়ে, আড়ি করে পালাতে যায় মায়ের কোলে না গিয়ে।

হাত বাড়িয়ে মুখে সে চায়, আমি তখন নাচারই, কাঁধের ‘পরে তুলে তারে করে বেড়াই পাচারি।

মনের মতো বাহন পেয়ে ভারি মনের খুশিতে মারে আমায় মোটা মোটা নরম নরম ঘুষিতে। আমি ব্যস্ত হয়ে বলি,

‘একটু রোসো রোসো মা,’ মুঠো করে ধরতে আসে আমার চোখের চশমা। আমার সঙ্গে কলভাষায় করে কতই কলহ তুমুল কাণ্ড, তোমরা তারে শিষ্ট আচার বলহ!

তবু তো তার সঙ্গে আমার বিবাদ করা সাজে না- সে নইলে যে তেমন করে ঘরের বাঁশি বাজে না। সে না হলে সকালবেলায় এত কুসুম ফুটবে কি? সে না হলে সন্ধেবেলায় সন্ধেতারা উঠবে কি?

একটি দণ্ড ঘরে আমার না যদি রয় দুরন্ত, কোনোমতে হয় না তবে বুকের শূন্য পূরণ তো।

দুষ্টুমি তার দখিন-হাওয়া সুখের-তুফান-জাগানে- দোলা দিয়ে যায় গো আমার হৃদয়ের ফুল-বাগানে। নাম যদি তার জিগেস কর সেই আছে এক ভাবনা,

কোন্ নামে যে দিই পরিচয় সে তো ভেবেই পাব না। নামের খবর কে রাখে ওর, ডাকি ওরে যা খুশি দুষ্টু বলো, দস্যি বলো, পোড়ারমুখি রাক্ষসি।

বাপ-মায়ে যে নাম দিয়েছে বাপ-মায়েরই থাক্ সে নয়- ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি তুলে রাখুন বাক্সে নয়।

একজনেতে নাম রাখবে কখন অন্ন প্রাশনে, বিশ্বসুদ্ধু সে নাম নেবে, ভারি বিষম শাসন-এ।

উপহার – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই, কী-যে দেব তাই ভাবনা। যত দিতে সাধ করি মনে মনে খুঁজে পেতে সে তো পাব না।

আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে সবাই করেছে একতা, বাকি যে এখন আছে কত ধন না তোলাই ভালো সে কথা।

সোনা রুপো আর হীরে জহরত পোঁতা ছিল সবই মাটিতে, জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে নে গেছে যে যার বাটীতে।

টাকাকড়ি মেলা আছে টাঁকশালে, নিতে গেলে পড়ি বিপদে। বসনভূষণ আছে সিন্দুকে, পাহারাও আছে ফি পদে।

এ যে সংসারে আছি মোরা সবে এ বড়ো বিষম দেশ রে, ফাঁকিঝুঁকি দিয়ে দূরে চলে গিয়ে ভুলে গিয়ে সব শেষ রে।

ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন যে যাহারে পারে দেয়-যে। তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়, কত মিছে হয় ব্যয়-যে।

স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত, চোখে যদি দেখা যেত রে, কতগুলো তবে জিনিসপত্র বল্ দেখি দিত কে তোরে।

তাই ভাবি মনে কী ধন আমার দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে- খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি। – বাস্, সব যাবে চুকিয়ে।

কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে কিনে রেখে দেব মন তোর, এমন আমার মন্ত্রণা নেই, জানি নে’ও হেন মন্তর। নবীন জীবন,

বহুদূর পথ পড়ে আছে তোর সুমুখে, স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই পিয়ে নিস এক চুমুকে।

সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে নব আশে, নব পিয়াসে- যদি ভুলে যাস, সময় না পাস, কী যায় তাহাতে কী আসে?

মনে রাখিবার চির-অবকাশ থাকে আমাদেরই বয়সে, বাহিরেতে যাব না পাই নাগাল অন্তরে জেগে রয় সে।



 

সুপ্তোত্থিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলম্বর। গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর।

অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি। মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুন ছাতি। জাগিল পথে প্রহরীদল, দুয়ারে জাগে দ্বারী,

আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী। উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রানীমাতা।

কচালি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা। নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দীপ জ্বালা, জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা-

‘কে পরালে মালা!’

খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলি নিল। আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল। এস্ত হয়ে চকিত চোখে চাহিল চারি দিকে- বিজন গৃহ, রতন-দীপ জ্বলিছে অনিমিখে।

গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে

সোনার সুতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে।

 

পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার, কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার। শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা- ‘আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,

কে পরালে মালা!’

নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক, বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক। . বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে, নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে। জাগিয়া উঠি বৈতালিক গাহিছে জয়গান, প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান। শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি- কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী। কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা, আধেক মুদি নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা-

‘কে পরালে মালা!’

বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি- দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি। শয়ন-‘পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়, এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয়। জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে- একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে।. বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হুহু, কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকিছে কুহু কুহু। নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা, শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা-

‘কে পরালে মালা!’

কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা-

দীপ্তিভরা নয়ন মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা।

স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয়- ভুলিয়া গেছে, রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময়। পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর,

এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর। চমকি মুখ দু হাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন, লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভে নি সেইক্ষণ!

কণ্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলিজ্বালা, শয়ন-‘পরে লুটায়ে পড়ে ভাবিল রাজবালা-

‘কে পরালে মালা!’

এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি। বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি। সঘন মেঘে বরষা আসে,

বরষে ঝরঝর্, কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর। স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা, সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা।

আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা, শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা।

ফাগুন-মাস আবার এল বহিয়া ফুলডালা, জানালা-পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা-

‘কে পবালে মালা!’

 

নিদ্রিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একদা রাতে নবীন যৌবনে স্বপ্ন হতে উঠিন চমকিয়া, বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার- ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।

শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,

পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর। আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ, ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।

সমুখে প’ড়ে দীর্ঘ রাজপথ,

দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার, নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে আপন-মনে ভাবিনু একবার- অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে

ধরার মাঝে নূতন কোন দেশে দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।

অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিন,

কত যে দেশ বিদেশ হনু পার! একদা এক ধূসরসন্ধ্যায় ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার। সবাই সেথা অচল অচেতন, কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী, নদীর তীরে জলের কলতানে ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি।

 

ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি, নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে।

প্রাসাদ-মাঝে পশিনু সাবধানে, শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে।

ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা, কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা।

একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা, ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা।

কমলফুলবিমল শেজখানি,

নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।

মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে, বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।

মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে।

একটি বাহু বক্ষ-‘পরে পড়ি, একটি বাহু লুটায় এক ধারে।

আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে, কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি- পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা

অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি।

দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি- ঘুমের দেশে স্বপন একখানি, পালঙ্কেতে মগন রাজবালা আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা।

ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু, না মানে বাধা হৃদয়কম্পন।

ভূতলে বসি আনত করি শির মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন। পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি, তাহারি পানে চাহিনু একমনে-

দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে।

ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া লিখিয়া দিনু আপন নামধাম।

লিখিনু, ‘অয়ি নিদ্রানিমগনা, প্রাণ তোমারে সঁপিলাম।’

যতন করি কনক-সুতে গাঁথি রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি- ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা, তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা ॥

এক গাঁয়ে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ।

তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি তাহার গানে আমার নাচে বুক।

 

     তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে, যদি ভাঙে আমার ক্ষেতের বেড়া কোলের ‘পরে নিই তাহারে তুলে।

    আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর     নামটা  অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে,     আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

        দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি, মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক।

                                         তাদের বনের অনেক মধুমাছি

   মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক। তাদের ঘাটে পূজার জবামালা     ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে, তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে।

  আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের এই নদীর      নামটি অঞ্জনা, আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে,      আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

  আমাদের এই গ্রামের গলি-‘পরে আমের বোলে ভরে     আমের বন। তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে মোদের ক্ষেতে তখন ফোটে শণ। তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে।

 

সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা। রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা, ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা- কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা- চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। পরপারে দেখি আঁকা গ্রামখানি মেঘে ঢাকা তরুছায়ামসী-মাখা প্রভাতবেলা। এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে! দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে। ভরা পালে চলে যায়, কোনো দিকে নাহি চায়, ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু ধারে দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে? বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে। যেয়ো যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে দাও- শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-‘পরে। আর আছে?- আর নাই, দিয়েছি ভরে। এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে- এখন আমারে লহো করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। শ্রাবণগগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে, শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি- যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

আরোও পড়ুন এইখান থেকে – রবীন্দ্রনাথের জীবনী……

About the Author

Aftab Rahaman

AFTAB RAHAMAN

I am Aftab Rahaman, the founder of KaliKolom.com. For over 10 years, I have been writing simple and informative articles on current affairs, history, and competitive exam preparation for students. My goal is not just studying, but making the process of learning enjoyable. I hope my writing inspires you on your journey to knowledge.

📌 Follow me: