মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
মোগল সাম্রাজ্য সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) মোগল সাম্রাজ্যের আয়তন সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। কিন্তু তাঁর রাজত্বকালেই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়।
বিদ্রোহ দমন করতে বৃদ্ধ সম্রাটকে সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছুটে বেড়াতে হয়। তাঁর মৃত্যুর (১৭০৭ খ্রি.) পর থেকেই সাম্রাজ্যে ধারাবাহিক ভাঙন শুরু হয়। শেষপর্যন্ত সর্বশেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের আমলে (১৮৩৭ ১৮৫৮ খ্রি.) মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল।
1. সাম্রাজ্যের বিশালতা
সম্রাট আকবর সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে মোগল সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত করেছিলেন এবং ঔরঙ্গজেবের আমলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ঔরঙ্গজেবের পূর্বে ভারতের ইতিহাসে এত বড়ো সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে রাজধানী দিল্লি থেকে দূরবর্তী প্রান্তগুলির দূরত্ব অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহ দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
2. অভিজাতদের দ্বন্দ্ব
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরবর্তী কালে মোগল অভিজাতশ্রেণির মধ্যে দলাদলি ও স্বার্থপরতা শুরু হলে মোগল প্রশাসনে এর বিরুপ প্রভাব পড়ে। ইরানি, তুরানি ও হিন্দুস্থানি নামে প্রধান তিনটি অভিজাতগোষ্ঠী একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বদা চক্রান্তে লিপ্ত হলে প্রশাসনে ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতি শুরু হয়। এর ফলে শাসনব্যবস্থায় দুর্বলতা দেখা দেয়। ড. সতীশচন্দ্র মনে করেন যে, অভিজাতগোষ্ঠীগুলির এরুপ দলাদলি রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের পক্ষে মোটেই শুভ হয়নি।
3. অর্থনৈতিক দুর্বলতা
- আকবরের পরবর্তী সময় থেকেই মোগল অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। এর ওপর রাজদরবারে সীমাহীন জাঁকজমক ও বিলাসিতা, বিশাল সেনাদলের বেতন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।
- সম্রাট শাহজাহান একের পর এক বিভিন্ন নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজকোশের বিপুল অর্থ অকাতরে ব্যয় করেন। তা ছাড়া তিনি কয়েকটি ব্যর্থ অভিযানে কোশাগারের বিপুল অর্থ অপব্যয় করেন। ফলে রাজকোশে ঘাটতি দেখা দেয় এবং প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ব্যয় নির্বাহ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
- ঔরঙ্গজেবের আমলে বিভিন্ন যুদ্ধ ও বিদ্রোহ দমনে রাজকোশের প্রভূত অর্থ ব্যয় হয়। ফলে মোগল রাজকোশে ঘাটতি দেখা দেয়। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইতিহাসবিদ মোরল্যান্ড বলেছেন,“দেশ যে দেউলিয়া তা ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর স্পষ্ট হয়ে যায়।”
4. জায়গিরদারি সংকট
মোগল প্রশাসনে বহু মনসবদারকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির দেওয়া শুরু হলে প্রশাসনে নানা সমস্যা দেখা দেয়। জাহাঙ্গীরের আমলে জায়গিরদারি ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয় এবং ঔরঙ্গজেবের আমলে তা প্রকট হয়। অশান্ত দাক্ষিণাত্য থেকে ভালো রাজস্ব আদায় হত না বলে বহু জায়গিরদার উত্তর থেকে দাক্ষিণাত্যে বদলি হতে চাইত না। ফলে উত্তরের জায়গির পাওয়ার জন্য প্রশাসনে নানা চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি প্রভৃতি শুরু হয়।
5. শাসকদের অযোগ্যতা
সম্পূর্ণ সামরিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব সম্রাটদের ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে একের পর এক অযোগ্য ও অপদার্থ শাসক মোগল সিংহাসনে বসলে শাসনব্যবস্থা ক্রমে ভেঙে পড়তে থাকে। বৃদ্ধ ও বিলাসপ্রিয় বাহাদুর শাহ, সুরা ও নর্তকীতে আসক্ত জাহান্দার শাহ, স্থূল আনন্দে নিমজ্জিত ফারুকশিয়ার, বিলাসপ্রিয় মহম্মদ শাহ প্রমুখের পক্ষে পতনশীল মোগল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
6. সামরিক ত্রুটি
সামরিক ত্রুটি মোগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা মোগল বাহিনীতে কোনো ঐক্য ও সংহতি ছিল না। মনসবদাররা যুদ্ধের সময় সম্রাটকে যে সেনা সরবরাহ করত তাদের আনুগত্য থাকত মনসবদারদের প্রতি, সম্রাটের প্রতি নয়। বহু মনসবদার নির্দিষ্ট সেনা না রেখে সম্রাটকে ফাঁকি দিত। তা ছাড়া মোগল সেনাবাহিনীর গতি ছিল খুবই ধীর এবং অস্ত্রশস্ত্রের প্রযুক্তি ছিল খুবই পুরোনো ও নিম্নমানের।
7. ঔরঙ্গজেবের দায়িত্ব
মোগল সাম্রাজ্যের পতনে ঔরঙ্গজেবের যথেষ্ট দায়িত্ব ছিল। তাঁর ত্রুটিপূর্ণ দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে দাক্ষিণাত্যে তীব্র মোগল-বিরোধী মারাঠা শক্তির উত্থান ঘটে। ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে বেশি সময় ব্যয় করলে উত্তর ভারতের প্রশাসন ভেঙে পড়ে। তাঁর ধর্মান্ধ নীতির ফলে রাজপুত, জাঠ, বুন্দেলা, সনামী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
আরো পড়ুন—আরব দুনিয়া, সর্বজনীন খলিফাতন্ত্র ইসলামি প্রজাতন্ত্র
৪. বৈদেশিক আক্রমণ
বিভিন্নভাবে যখন মোগল সাম্রাজ্য নানা সংকটে জরাজীর্ণ তখন নাদির শাহ (১৭৩৮-৩৯ খ্রি.) ও আহম্মদ শাহ আবদালীর আক্রমণ (১৭৪৮-৬৭ খ্রি.) মোগল সাম্রাজ্যের চরম ক্ষতিসাধন করে। সাম্রাজ্যের আর্থিক ও সামরিক শক্তি ভেঙে পড়ে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাধীনতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
উপসংহার:
মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ লুপ্ত হলেও সাম্রাজ্যের পতন প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমিক পতন এবং ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার একইসঙ্গে ঘটতে থাকে।