বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্যগুলি ছিল নিম্নরূপ:

- সাংস্কৃতিক সমন্বয় ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব:
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের সংস্কৃতি, দর্শন ও জ্ঞানের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব। বিশ্বভারতীকে তিনি “বিশ্বের সকল সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র” হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। - প্রকৃতিনির্ভর ও সৃজনশীল শিক্ষা:
প্রথাগত শ্রেণীকক্ষের পরিবর্তে প্রকৃতির কোলে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদানের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বিকাশ শিক্ষার অপরিহার্য অংশ। - ভারতীয় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়:
ভারতীয় সংস্কৃতি, দর্শন ও স্থানীয় জ্ঞানের গভীর অনুশীলনের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও বিশ্বের অন্যান্য প্রগতিশীল চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এর লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে স্বদেশী চেতনায় সমৃদ্ধ একটি শিক্ষাক্রম গড়ে তোলা। - গ্রামীণ উন্নয়ন ও সমাজসেবা:
বিশ্বভারতীর সঙ্গে “শ্রীনিকেতন” প্রকল্প যুক্ত ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। কৃষি, হস্তশিল্প ও স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী গ্রাম গঠনে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। - শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করা:
রবীন্দ্রনাথের দর্শন অনুযায়ী, শিক্ষা কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়—এটি জীবনদর্শন ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের হাতিয়ার। বিশ্বভারতীতে শিক্ষার্থীরা শিল্প, সংগীত, নৃত্য ও হস্তকর্মের মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব গঠনের সুযোগ পেত। - আন্তর্জাতিকতাবাদ:
বিশ্বভারতী “যেখানে বিশ্ব বিশ্বের ঘর হয়” (“Where the world makes a home in a single nest”)—এই আদর্শে পরিচালিত হয়। এটি বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য একটি মুক্ত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠেছিল, যেখানে বহুভাষা ও বহুসংস্কৃতির সহাবস্থান সম্ভব হয়।
মহত্ত্ব ও স্বীকৃতি:
১৯৫১ সালে বিশ্বভারতীকে “কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়”-এর মর্যাদা দেওয়া হয়। ২০০১ সালে ইউনেস্কো এটিকে “বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিষ্ঠান আজও তার আদর্শে সমাজসেবা, শান্তি ও সৃজনশীল শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলেছে।