মধ্যযুগের ভারতে ভক্তি আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য
সূচনা :- সুলতানি যুগে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিম ভাবধারার মধ্যে যে সমন্বয় সাধিত হয়েছিল তার ফলে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এক নতুন ধর্মীয় আন্দোলন সৃষ্টি হয়। আর এই আন্দোলনই ইতিহাসে ভক্তি আন্দোলন নামে পরিচিত । ঐতিহাসিক আর্শীবাদ লাল শ্রীবাস্তব এই আন্দোলনের ব্যাপকতা ও জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন,Perhaps After The Decline of Budhhism , There Has Never Been a More Wides Ead And Popular Movement in Our Country Than The Bhakti Movement ”.
ভিক্তিবাদের উপত্তি :- ভক্তিবাদের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। ঐতিহাসিক ওয়েবার বলেছেন , “ মােক্ষলাভের পথ হিসাবে ভক্তিমার্গের ধারণা খ্রিস্টধর্ম থেকেই নেওয়া হয়েছে। ” ঐতিহাসিক গ্ৰীয়ারসনও একই মতের অনুগামী । কিন্তু ডঃ আই . এইচ . কুরেশি , ডঃ তারাচঁাদ, ডঃ রােমিলা থাপার, অধ্যাপক ইউসুফ হুসেন প্রমুখ ভক্তিধর্মের উদ্ভবে ইসলামের প্রভাবকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাদের মতে , ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধ্যানধরাণা, যথা একেশ্বরবাদ , বিশ্বভ্রাতৃত্ববােধ , সামাজিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সম – অধিকারবােধ প্রভৃতি থেকেই ভক্তিবাদ প্রেরণালাভ করেছিিল।
অবশ্য ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ . এল . শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ভক্তিবাদের উদ্ভবে ইসলামের প্রভাবকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে ইসলামের তত্ত্ব অ মুসলিমদের জন্য কোনাে সার্বিক সাম্যের বাণী গ্রহণ করে আনেননি। প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মের মধ্যেই ভক্তিবাদের বীজ নিহিত ছিল এবং এক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম পরােক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। কেননা ভারতে ইসলাম ধর্মের দ্রুত প্রসারের ঘটনা হিন্দুধর্মের সামনে এক সংকট সৃষ্টি করেছিল। আর এই সংকট দূর করার জন্যই হিন্দু সংস্কারকগণ হিন্দু দর্শনে, মানুষের মুক্তির জন্য যে তিনটি মার্গ বা পথ অর্থাৎ জ্ঞান , কর্ম ও ভক্তি মার্গ নির্দেশিত হয়েছে তার মধ্যে থেকে ভক্তি মার্গ গ্রহণ করে হিন্দুধর্মকে সহজ, সরল ও জনপ্রিয়তা করে তুলতে সচেষ্ট হন। ভক্তিবাদ প্রথমে দক্ষিণ ভারতে বিকশিত হয় এবং পরবর্তীকালে তা উত্তর ভারতে প্রচারিত হয়।
ভিক্তিবাদের প্রচারের কারণ :- ভক্তিবাদের অন্যতম আদি প্রবক্তা ছিলেন বৈয়ব সাধক যমুনা মুনির শিষ্য রামানুজ অঙ্কের তিরুপতিতে জন্মগ্রহণকারী এই সাধক ভক্তিকে মুক্তির প্রকৃত পথ হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং জাতিভেদ প্রথার নিন্দা করেন । রামানন্দ ছিলেন রামানুজের অন্যতম শিষ্যয। তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তিবাদের বাণী উত্তর ভারতে বহন করে আনেন এবং বিস্তীর্ণ অলে এই মতবাদ প্রচার করেন। রামানন্দ শিষ্য কবীর ছিলেন অপর বিখ্যাত ভক্তিধর্মের প্রচারক। তিনি ছােটো ছােটো গীতি কবিতা বা দোহার আকারে তার বাণীর প্রচার করেন । ডঃ তারাচাদের মাতে “ সর্ব ধর্ম সমন্বয় ও মানব প্রেমের বাণী প্রচার ছিল কবীরের লক্ষ্য । ” মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে আর একজন শ্রেষ্ঠ ভক্তিবাদী ধর্মপ্রচারক ছিলেন নানক । তিনি মূর্তিপূজার বিরােধিতা করেন । এবং হিন্দু ও ইসলাম দু’ধর্মেরই বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানেরও নিন্দা করেন।
আরও দেখুন: ভক্তি আন্দোলনের উত্থান ও প্রভাব