বিভিন্ন মহাদেশে বহির্গমন:
আফ্রিকা থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহাদেশীয় ভূখণ্ডে আদিম মানুষের পরিযান ঘটেছিল বলে পণ্ডিতগণ অভিমত দিয়ে থাকেন।
1. ইউরোপ মহাদেশে যাত্রা :- আফ্রিকা মহাদেশের ভূখণ্ড থেকে আদিম মানুষের আধুনিক বংশধর সর্বপ্রথম নিকটবর্তী ইউরোপীয় ভূখণ্ডে পৌঁছোয়। @ আরবের পথ: আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষের পক্ষে ইউরোপে পৌঁছোনো খুবই সহজ ছিল। আরবের ভূখণ্ড হল আফ্রিকার সঙ্গে ইউরোপের সংযোগস্থল। আরবের স্থলভাগের ওপর দিয়ে তারা খুব সহজেই ইউরোপ মহাদেশীয় ভূখণ্ডে পৌঁছে গিয়েছিল। আরবের উত্তরদিকের পথ:- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির (National Geographic Society) সম্মেলনে জানানো হয়েছে যে, আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষ আরবের দক্ষিণ প্রান্তের পথ ধরে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। উত্তরদিকের মিশরীয় পথ ধরে তারা ইউরোপের দিকে যাত্রা করেনি।
2. এশিয়া মহাদেশে যাত্রা :- আফ্রিকার আদিম মানুষের বংশধররা সুদূর অতীতে এশিয়া মহাদেশে পদার্পণ করেছিল এবং এই মহাদেশের দূরদূরান্তের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা প্রধানত দুটি ধারায় এশিয়া মহাদেশে পৌঁছেছিল— ইউরোপ থেকে :- আদিম মানুষ প্রথম আফ্রিকা থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ইউরোপ থেকে স্থলপথে এশিয়া মহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। তবে এই পরিযান প্রথমে পশ্চিম এশিয়া এবং পরে চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে ঘটেছিল। কারণ, চিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে মানুষের পূর্বপুরুষের যতটা প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে সে তুলনায় ভারতে প্রাপ্ত আদিম মানুষের নিদর্শনগুলি ততটা প্রাচীন নয়।
আরবের পথ :- আই. বি. এম.-এর সিনিয়র ম্যানেজার অজয় রোয়ুরু (Ajay Royyuru) তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে, আফ্রিকা থেকে আদিম মানুষের একটি শাখা আরব হয়ে ইউরেশিয়ার পথ ধরে ভারতে প্রবেশ করেছিল। তিনি জিনতত্ত্বের গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দক্ষিণ ভারতের মানবগোষ্ঠী ইউরোপের তুলনায় বরং আফ্রিকার মানবগোষ্ঠীর অনেক কাছাকাছি। যাই হোক, এশিয়া মহাদেশের মেসোপটেমিয়া, ভারত, চিন প্রভৃতি দেশের নানা স্থানে আদিম মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল।
3. উত্তর আমেরিকায় যাত্রা:- আদিম মানুষ আজ থেকে অন্তত ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর পূর্বে এশিয়া মহাদেশ না থেকে উত্তর আমেরিকায় পদার্পণ করেছিল। বেরিং প্রণালীর পথ:- বেরিং প্রণালী ধরে এশিয়া থেকে আমেরিকার দূরত্ব মাত্র ৫০ মাইল। বেরিং প্রণালীর এই ৫০ মাইল পথ অতিক্রম করে আদিম মানুষ এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। সেই সময় তুষার যুগ চলছিল বলে বেরিং প্রণালীর বৃহদংশ বরফে ঢাকা ছিল। এই বরফের ওপর দিয়ে মানুষ উত্তর আমেরিকায় পৌঁছেছিল। বিচ্ছিন্নতা:- আজ থেকে দশ হাজার বছর পূর্বে যখন সর্বশেষ তুষার যুগের অবসান ঘটে তখন সমুদ্রের বরফ গলে জলে পরিণত হয়। ফলে এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার ভূখণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ফলে আদিম মানুষ পরবর্তীকালে আর এই পথে উত্তর আমেরিকায় যেতে পারেনি। ভাইকিংদের অভিযান :- কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন যে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী নাগাদ ভাইকিংরা ইউরোপ থেকে গ্রিনল্যান্ড, নিউফাউন্ডল্যান্ড, লাব্রাডার উপকূল প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময় লিফ নামে জনৈক ভাইকিং-এর নেতৃত্বে বেশ কিছু নরনারী গবাদিপশু সহ লাব্রাডার উপকূলে বসবাস করতে যায়। অবশ্য ভাইকিংদের এই যাত্রা সম্পর্কে বিতর্ক আছে।
4. দক্ষিণ আমেরিকায় যাত্রা:- পানামা যোজক অতিক্রম: আদিম মানুষ উত্তর আমেরিকায় পৌঁছোনোর পর সেখান থেকে পরবর্তীকালে আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছিল। দক্ষিণের পানামা যোজকের বরফের উপর দিয়ে তারা দক্ষিণ আমেরিকার ভূখণ্ডে পদার্পণ করেছিল। এরপর ধারাবাহিক বিস্তার লাভের মাধ্যমে তারা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিচ্ছিন্নতা:- পরবর্তীকালে উয়যুগে সমুদ্রের জলরাশির দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা হাজার হাজার বছর ধরে বহির্জগতের প্রভাবমুক্ত হয়ে সেখানে বসবাস করছিল। এই দক্ষিণ আমেরিকাতেই সুপ্রাচীন মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পরবর্তীকালে স্পেনীয় নাবিক কোর্টেস দক্ষিণ আমেরিকার অ্যাজটেক সভ্যতার সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি দেখে অবাক হলেও তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, সেখানকার বাসিন্দারা তখনও প্রস্তর যুগেই পড়ে আছে, লৌহ যুগে পৌঁছোতে পারেনি।
5. অস্ট্রেলিয়ায় যাত্রা:- তুষার যুগে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সংলগ্ন সংকীর্ণ সমুদ্রের জলরাশি বরফে পরিণত হয়। এই বরফের ওপর দিয়েই মানুষ এশিয়া থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। 0 ইন্দোনেশিয়ায় যাত্রা:- আদিম মানুষ আজ থেকে অন্তত ত্রিশ হাজার বছর পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বরফের সমুদ্র অতিক্রম করে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপে পৌঁছোয় ৷ অস্ট্রেলিয়া যাত্রা: ইন্দোনেশিয়া থেকে সমুদ্রের বরফের ওপর দিয়ে আরও এগিয়ে তারা পৌঁছে যায় অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। তুষার যুগের অবসানের পরবর্তীকালে এই ভূখণ্ড আবার সমুদ্রের জলরাশির দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে আদিম মানুষ বহির্জগতের প্রভাবমুক্ত হয়ে সেখানে বসবাস করতে থাকে। তবে ভৌগোলিক আবিষ্কারের পরবর্তীকালে এখানে ইউরোপীয়রা ব্যাপক হারে এসে এখানকার প্রাচীন জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে থাকে।