নব্যবঙ্গ আন্দোলন বলতে কী বোঝ | নব্যবঙ্গ আন্দোলনের গুরুত্ব | নব্যবঙ্গ’ গোষ্ঠীর উদ্যোগ

নব্যবঙ্গ আন্দোলন বলতে কী বোঝ

Join Telegram

Table of Contents

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র (১৮০৯-৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে তাঁর অনুগামী একদল যুবক বাংলার সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে এক আন্দোলনের সূচনা করেন। ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী ছাত্রমণ্ডলী ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী‘ নামে এবং তাঁদের উদ্যোগে পরিচালিত আন্দোলন ‘নব্যবঙ্গ আন্দোলন‘ নামে পরিচিত। ডিরোজিও ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ ভারতীয় বলেই মনে করতেন। তাঁর লেখা ‘ফকির অব জঙ্ঘিরা’ নামে কাব্যগ্রন্থের ‘আমার স্বদেশভূমি, ভারতের প্রতি’ কবিতায় তাঁর স্বদেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়।

ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

ডিরোজিও ১৮২৬-এ হিন্দু কলেজে সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি অল্পদিনেই আদর্শ ও ছাত্রদরদি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রভাবে তাঁর ছাত্ররা লক, হিউম, টম পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের মতবাদ ও ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি তাঁর ছাত্রদের বিনা বিচারে কিছু মেনে না নিতে পরামর্শ দেন। ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটানোর জন্য তিনি ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮২৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীরা অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদপ্রথা, সতীদাহপ্রথা, মূর্তিপূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতেন। তাঁদের মুখপত্র ছিল ‘এথেনিয়াম’। তাঁদের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘পার্থেনন’ (১৮২৯ খ্রি.) পত্রিকায় নিয়মিতভাবে নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতির সপক্ষে এবং ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ পত্রিকায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী শীঘ্রই রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়। তাঁরা নিষিদ্ধ মাংস খেয়ে, উপবীত ছিঁড়ে হিন্দুদের রক্ষণশীলতার প্রতিবাদ করে। নব্যবঙ্গদের এরূপ উগ্র কার্যকলাপের ফলে অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের হিন্দু কলেজ থেকে ছাড়িয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে থাকেন। ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করে। এরপর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ডিরোজিও ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু ডিরোজিওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সংস্কারের আদর্শ হারিয়ে যায়নি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামী ‘নব্যবঙ্গ’ নামে পরিচিত ছাত্রদল এই সংস্কার আন্দোলনের আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যান। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃয় মল্লিক, প্যারিচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর কার্যাবলির মূল্যায়ন

নব্যবঙ্গ দলের কাজকর্মের গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন মতপার্থক্য দেখা যায়। কেউ কেউ সমালোচনা করে তাঁদের ‘উচ্ছৃঙ্খল’ বা ‘কালাপাহাড়’ বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন “এক প্রজন্মেই তাঁদের সব শেষ। তাঁদের পিতা বা সন্তান-সন্ততি নেই।” ড. অমলেশ ত্রিপাঠী, ড. সুমিত সরকার প্রমুখ। ঐতিহাসিক নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রশংসা করেননি। বস্তুত নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, নব্যবঙ্গরা গঠনমূলক চিন্তাধারার পরিবর্তে নেতিবাচক চিন্তাধারা আঁকড়ে ছিলেন। তাঁরা হিন্দু সমাজ ও ধর্মকে উগ্রভাবে আক্রমণ করলে হিন্দুসমাজ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাঁদের বিপক্ষে চলে যায়। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সামাজিক কুসংস্কার নিয়ে নানা কথা বললেও দেশের দরিদ্র কৃষক শ্রমিকদের কল্যাণে কোনো উদ্যোগ নেননি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন বা কুটিরশিল্পের ধ্বংসের ফলে সাধারণ মানুষ যে-দুর্দশার শিকার হয়েছিল

সেবিষয়ে তাঁরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। তৃতীয়ত, নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আন্দোলন বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি। শুধু শহুরে উচ্চশিক্ষিত কিছু তরুণের মধ্যে এই আন্দোলনের প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল। ডেভিড কফ তাঁদের ‘ভ্রান্ত পুথিপড়া বুদ্ধিজীবী’ বলে সমালোচনা করেছেন। চতুর্থত, মুসলিম সমাজের সংস্কারের বিষয়ে নব্যবঙ্গদের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। পঞ্চমত, ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে তাঁর অনুগামীরা ধীরে ধীরে নিজ নিজ চাকরি ও ব্যাবসায় মনোনিবেশ করলে আন্দোলন গতি হারিয়ে ফেলে।

বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর উদ্যোগ ও আন্দোলনের বেশকিছু সদর্থক দিক ছিল। ডিরোজিওর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীদের উদ্যোগে ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়েরার’, ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর, হিন্দু পাইওনিয়ার’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাঁরা ‘সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’, ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ (১৮৩০ খ্রি.) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা নারী-নির্যাতন, নারী-পুরুষের অসাম্য, দাসপ্রথা, সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সবর হন। কৃষ্ণদাস পাল তাঁদের ‘দেশের ভবিষ্যৎ’ বলে অভিহিত করেছেন এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র তাঁদের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, নব্যবঙ্গরা ছিলেন “বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক, তাঁরা আমাদের জাতির পিতা, তাঁদের গুণাবলী চিরস্মরণীয়।”

Join Telegram

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *