প্রাচীন গ্রিস এবং প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক স্তরভেদ ও অসাম্যের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন গ্রিসে যেমন ক্রীতদাস ব্যবস্থার অস্তিত্ব সেখানকার সমাজে স্বাধীন নাগরিক ক্রীতদাসদের মধ্যে অসাম্য সৃষ্টি করেছিল, তেমনি প্রাচীন ভারতে বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থা সমাজে নানা বৈষম্যের সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য প্রাচীন গ্রিস বা রোমে ক্রীতদাস বলতে যাদের বোঝানো হত, সেই অর্থে প্রাচীন ভারতে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব ছিল না। তবে ভারতীয় সমাজে তখন ব্রাত্য, নিষাদ, পতিত ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বিভিন্ন অচ্ছুত জাতির উত্থান ঘটেছিল। আবার বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে সামাজিক সংমিশ্রণের ফলে ভারতে রাজপুত জাতির মতো বীর যোদ্ধৃজাতিরও উদ্ভব ঘটে।
ভারতের ক্রীতদাস ব্যবস্থা | ক্রীতদাস ব্যবস্থা কাকে বলে
সুপ্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপক অস্তিত্ব থাকলেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ক্রীতদাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল কি না সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ভারতে আগত গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, সেসময় ভারতে কেউ ক্রীতদাস ছিল না। কিন্তু অন্যান্য বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন ভারতে ক্রীতদাসপ্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে সুলতানি আমলেও ভারতে ক্রীতদাসপ্রথার তীব্রতা ছিল বলে জানা যায়।
প্রাচীন যুগে ভারতে দাস ব্যবস্থা
বিভিন্ন বৈদিক সাহিত্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, অশোকের বিভিন্ন শিলালিপি, বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতি থেকে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে দাসপ্রথার অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়। হরপ্পা সভ্যতার যুগে, বৈদিক যুগে, মৌর্য যুগে, গুপ্ত যুগে, এমনকি গুপ্ত যুগের পরবর্তীকালে বা সুলতানি যুগের পূর্বেও ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল। তবে গ্রিস বা রোমের ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে ভারতের দাসপ্রথার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। ভারতের দাসরা ছিল প্রধানত গৃহদাস। দাসদের শ্রমের বিনিময়ে উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারগুলিতে সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করত।
আরো পড়ুন:- মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
1. হরপ্পা সভ্যতায় ক্রীতদাস ব্যবস্থা
হরপ্পা সভ্যতার সামাজিক জীবন সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হরপ্পা সভ্যতার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী থেকে অনুমান করা হয় যে, এখানে রাজতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। সিন্ধুর নগরগুলির চারপাশে যে কৃষিজমিতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হত তার আবাদকারী কৃষকরা নগরের শাসকদের দ্বারা ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ মার্টিমার হুইলার মনে করেন।
2. বৈদিক যুগে ক্রীতদাস ব্যবস্থা
ঋগ্বৈদিক যুগে ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। (1) ঋগ্বেদে অনার্য শত্রুদের ‘দাস’ বা ‘দস্যু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ যুগে ‘দস্যু’রা আর্যদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ‘দাস’-এ পরিণত হত এবং তাদের ঘরবাড়ি ও জমি বাজেয়াপ্ত করা হত। পরাজিত দাসরা বিজয়ী আর্যদের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হত। আর্যরা নিজেদের কৃষিকাজে দাসদের নিয়োগ করে বাড়তি উৎপাদন লাভ করত। ঋগ্ববেদে আর্যদের দেবতা ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ বলা হয়েছে। কারণ তিনি শত্রু ‘দাস’ বা ‘দস্যু’-দের ‘পুর’ বা দুর্গগুলি ধ্বংস করেছিলেন। (2) পরবর্তী বৈদিক যুগে শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান খুবই নীচে নেমে গিয়েছিল। তারা এই সময় অপবিত্র ও অস্পৃশ্য বলে গণ্য হত। তারা আর্যদের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছিল। আর্যরা ইচ্ছা করলে তাদের হত্যাও করতে পারত। এক্ষেত্রে শূদ্রদের জীবন দাসদের থেকে পৃথক ছিল না।
3. মৌর্য যুগে ক্রীতদাস ব্যবস্থা
(1) মৌর্য যুগে ভারতে আগত গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তাঁর ইন্ডিকা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল না। তিনি বলেছেন যে, “সব ভারতীয় স্বাধীন। তাদের মধ্যে কেউ ক্রীতদাস নেই।” কিন্তু মেগাস্থিনিসের বক্তব্য যথার্থ—এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। (2) ইতিহাসবিদ বনগার্ড লেভিনের মতে, বৌদ্ধ জাতক, অর্থশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র ও অশোকের শিলালিপিগুলি থেকে মৌর্য যুগে দাসপ্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। জাস্টিন লিখেছেন
“আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রিক শাসকদের হত্যা করে ভারতীয়রা দাসত্বমুক্ত হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক ছিলেন স্যান্ড্রোকোট্টাস বা চন্দ্রগুপ্ত।”
(3) কৌটিল্য দাসপ্রথাকে ‘ম্লেচ্ছপ্রথা’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির দাস এবং তাদের অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি তাঁর অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন যে, যুদ্ধে বন্দি হওয়া, দারিদ্র্য, আত্মবিক্রয়, শাস্তি, জন্মসূত্র প্রভৃতি হল এ যুগের দাসত্বের উৎস।
(4) মৌর্য যুগে দাসরা বিভিন্ন সরকারি শিল্পসংস্থা, ধনীদের গৃহ ও খামার, রাজপরিবারের অন্দরমহল প্রভৃতি স্থানে কাজ করত।
4. গুপ্ত যুগে দাস ব্যবস্থা
গুপ্ত যুগেও ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়।
(1) এ যুগে দাসদের কেনাবেচা, দান বা হস্তান্তর করা চলত। মনুস্মৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অপরাধীদের শাস্তি হিসেবে তাদের দাসে পরিণত করা হত।
(2) নারদস্মৃতিতে উল্লেখ আছে যে, দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যের জন্য কেউ কেউ স্বেচ্ছায় দাসত্ব বরণ করত। অবশ্য উচ্চবর্ণের লোকদের দাসে পরিণত করার পথে অনেকরকম বাধা ছিল।
(3) সমকালীন ধর্মশাস্ত্রগুলিতে দাসদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, কোনো দাস তার প্রভুর জীবন রক্ষা করলে সেই দাসকে মুক্তি দেওয়া উচিত।
5. পাল ও সেন যুগে দাস ব্যবস্থা
(1) সুলতানি যুগের পূর্ববর্তী পাল ও সেনযুগে এদেশে দাসপ্রথার অস্তিত্ব ছিল। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-এ পালবংশকে ‘দাসজীবিণঃ’ বা দাস বংশীয় শূদ্র বলা হয়েছে।
(2) সেনযুগে জাতিভেদপ্রথা তীব্রতর হলে শূদ্রদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। তখন তাদের জীবন দাসদের সমপর্যায়ভুক্ত ছিল।
সুলতানি যুগে ভারতে দাস ব্যবস্থা
মুসলিম দুনিয়ায় প্রাচীন কাল থেকেই দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। গজনি ও ঘুর রাজ্যের মুসলিম শাসকদের ভারত আক্রমণ করার পেছনে এদেশ থেকে দাস সংগ্রহ করাও অন্যতম কারণ ছিল।
(1) কুতুবউদ্দিন আইবক ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট অভিযান করে ২০ হাজার দাস এবং ১২০২ খ্রিস্টাব্দে কালিঞ্জুর অভিযান করে ৫০ হাজার দাস সংগ্রহ করেন। পরবর্তীকালের সুলতানদের সামরিক অভিযানেও দাস সংগ্রহ ছিল অন্যতম লক্ষ্য।
(2) ইবন বতুতা জানিয়েছেন যে, সুলতানি আমলে সামরিক অভিযান চালিয়ে দাসদাসী সংগ্রহ করার রীতি ছিল। স্বদেশ ছাড়া বিদেশ থেকেও এই সময় দাস আমদানি করা হত। উদাহরণ হিসেবে চিন, আফ্রিকা, তুর্কিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে ভারতে দাস আনা হত। এদেশে আফ্রিকার সুদক্ষ হাবসি দাসদের যথেষ্ট চাহিদা ছিল।
(3) পক্ষান্তরে, ভারত থেকেও মুসলিম দুনিয়ায় দাস রপ্তানি হত। তবে ফিরোজ তুঘলক ভারত থেকে দাস রপ্তানি বন্ধ করে দেন। দাসদের দেখাশোনার উদ্দেশ্যে তিনি দিল্লিতে একটি পৃথক দপ্তর গঠন করেন।
1. শ্রেণিবিভাগ : সুলতানি আমলে প্রধানত দুই ধরনের দাস ছিল। (1) বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত বন্দগান-ই-খাস নামে দাসরা ছিল সুলতানের খাস দাস। তারা অনেকেই সুলতানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত হয়ে উঠত। বিশ্বস্ত দাসরা সুলতানের কাছের মানুষ হওয়ায় সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সুলতানের সুযোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে এরাই সিংহাসন দখল করত। কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, বলবন প্রমুখ এরূপ দাসের অন্যতম উদাহরণ।
(2) বিভিন্ন উচ্চবংশীয় অভিজাত এবং সাধারণ পরিবারের অধীনেও প্রচুর সংখ্যক দাস থাকত। এরা বুরদা ও কানিজক নামে পরিচিত ছিল। এরূপ দাসরা প্রভু ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত কাজে নিযুক্ত থাকত। এ ছাড়া প্রভুর সশস্ত্র অনুচর বা শ্রমিক হিসেবেও তারা কাজ করত।
2. ব্যাপকতা : ভারতে সুলতানি যুগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দাসপ্রথার গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি ছিল। এ যুগের অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ব্যক্তি নিজের অধীনে দাস রাখতেন। তাদের সামাজিক সম্মানও তাদের অধীনস্থ দাসের সংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হত। আলাউদ্দিন খলজির দাসের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। ফিরোজ তুঘলকের মন্ত্রী খান-জাহান মকবুলের উপপত্নী দাসীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার। ধনী পরিবারগুলি ছাড়াও বিভিন্ন উচ্চবংশীয় পরিবারে এ যুগে দাস রাখা হত। দিল্লির নূর তুর্ক নামে এক দরবেশের এবং অত্যন্ত দরিদ্র জনৈক নিজামুদ্দিনেরও একজন করে দাস ছিল৷
3. দাস বাজার
সুলতানি যুগে দিল্লি-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে দাস ক্রয়বিক্রয়ের বাজার গড়ে উঠেছিল। সমকালীন ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বরনি আলাউদ্দিন খলজির আমলে দিল্লির দাস বাজারের উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, এই সময় গৃহকর্মরতা একজন সাধারণ দাসীর মূল্য ছিল ৫-১২ তঙ্কা, একজন উপপত্নী দাসীর মূল্য ২০-৪০ তঙ্কা, একজন সুন্দরী দাসীর মূল্য ১০০-১৫০ তঙ্কা, একজন সাধারণ দাসের মূল্য ১০-১৫ তঙ্কা এবং একজন শক্তিমান দাসের মূল্য ৪০-১৬০ তঙ্কা। চতুর্দশ শতকে যখন দিল্লির বাজারে একটি নিকৃষ্ট টাট্টু ঘোড়ার দাম ছিল ১০ থেকে ২৫ তঙ্কা, তখন দেবগিরির বাজারে মাত্র ৫ তঙ্কায় দাস বিক্রি হত। এ থেকে বোঝা যায় যে, তখন দাসের মূল্য গৃহপালিত পশুর চেয়েও কম ছিল। ত্রয়োদশ শতকে বাংলা দেশে ও অন্যান্য স্থানে ‘খোজা’ নামে নপুংসক দাস কেনাবেচা চলত। এদের সুলতানের হারেম পাহারার কাজে নিযুক্ত করা হত। সুলতানি যুগে ভারত থেকে প্রচুর দাস বিদেশে রপ্তানি করা হত। তবে সুলতানি যুগের পরবর্তীকালে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দাসপ্রথা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং এর ব্যাপকতা হ্রাস পায়। মোগল আমলে ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকদের রচনায় বিশাল আকারের দাস বাজারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। দাসদের পরিবর্তে এই সময় প্রচুর স্বাধীন শ্রমিকের আবির্ভাব ঘটে ৷