রানি দুর্গাবতী | রানী দুর্গাবতী কে ছিলেন

রানি দুর্গাবতী

Join Telegram

দিল্লিতে মোগল শাসনকালে ভারতে যে সকল আঞ্চলিক শক্তির অস্তিত্ব ছিল সেগুলির মধ্যে গণ্ডোয়ানা ছিল অন্যতম। মধ্যপ্রদেশের সাগর, দামো, মাণ্ডলা ও নর্মদা উপত্যকার কিছু অঞ্চল নিয়ে গণ্ডোয়ানা রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর রাজধানী ছিল গড়-কাটাঙ্গা। গণ্ডোয়ানায় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের

রানি দুর্গাবতী
রানি দুর্গাবতী

ফলে এর উপর বহিরাগতদের লোভাতুর দৃষ্টি ছিল। এখানকার রানি দুর্গাবতী শাসনদক্ষতা ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় অসামান্য আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন।

রানী দুর্গাবতী কে ছিলেন

পূর্বপরিচয়

মাহোবা-র চান্দেল্ল বংশীয় রাজপুত রাজা কিরাত রাই-এর কন্যা দুর্গাবতী ছিলেন বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, অশ্বারোহণে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনায় সুদক্ষ।

  1. বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ : একদা গণ্ডোয়ানার শাসক সংগ্রাম শাহের পুত্র দলপৎ শাহের বীরত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজে মুগ্ধ হয়ে দুর্গাবতী দলপৎ শাহকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিখ্যাত চান্দেল্ল বংশের রাজকন্যা দুর্গাবতীকে তাঁর পিতা দলপৎ শাহের মতো একজন নীচুবংশজাত রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।
  2. বিবাহ : অবশ্য শেষপর্যন্ত দলপৎ শাহের বীরত্বে দুর্গাবতীর পিতাও মুগ্ধ হন এবং বিবাহে সম্মত হন। বিবাহের (১৫৪২ খ্রি.) কিছুদিন পরেই সংগ্রাম শাহের মৃত্যু হলে দলপৎ শাহ গণ্ডোয়ানার সিংহাসনে বসেন এবং দুর্গাবতী গণ্ডোয়ানার রানি হন। তাঁদের সুখী দাম্পত্যে এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে (১৫৪৫ খ্রি.), যার নাম রাখা হয় বীরনারায়ণ

সিংহাসন লাভ

  1. শাসন ক্ষমতা দখল : কিন্তু বীরনারায়ণের বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে দলপৎ শাহের মৃত্যু হয়। রাজা দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র বীরনারায়ণ গণ্ডোয়ানার সিংহাসনে বসেন। এই সময় নাবালক বীরনারায়ণের অভিভাবিকা হিসেবে তাঁর মাতা রানি দুর্গাবতী গণ্ডোয়ানার শাসন ক্ষমতা দখল করেন (১৫৫০ খ্রি.) এবং ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার শাসন পরিচালিত হয়।
  2. শাসনকার্যে দক্ষতা : গণ্ডোয়ানার রানি দুর্গাবতী ছিলেন মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য নারী যিনি রাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসন পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সাহসী ও সংস্কৃতিমনস্ক। স্বদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। দুর্গাবতীর শাসনকালে গণ্ডোয়ানায় সার্বিক অগ্রগতি ঘটেছিল।

[su_divider top=”no” divider_color=”#171212″ link_color=”#161010″ size=”2″ margin=”5″]

দক্ষ নেতৃত্ব

দুর্গাবতী দ্রুত স্বামীর মৃত্যুশোক ভুলে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেন। তিনি শীঘ্রই নিজের শাসন দক্ষতার প্রমাণ দেন।

  1. আক্রমণ প্রতিরোধ : এই সময় আফগান নেতা বাজ বাহাদুর গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করলে তিনি দক্ষতার সঙ্গে বাজ বাহাদুরের আক্রমণ প্রতিহত করেন। বাজ বাহাদুর আরও কয়েকবার গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করলেও রানি দুর্গাবতীর বাহিনীর কাছে পরাজিত হন।
  2. রাজকোশে সংকট : কিন্তু বাজ বাহাদুরের বিরুদ্ধে জয় সত্ত্বেও বারংবার যুদ্ধে গণ্ডোয়ানার প্রচুর অর্থসম্পদ ব্যয়িত হয় এবং রাজকোশে সংকট দেখা দেয়। ও আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি : রাজকোশ পূর্ণ করতে রানি দুর্গাবতী ক্ষুদ্র জোতদারদের কাছ থেকে বলপ্রয়োগ করে অর্থ আদায়ের নির্দেশ দেন। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই রাজকোশ পূর্ণ হয়ে যায়।

আরো পড়ুন – মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

মোগল আক্রমণ ও দুর্গাবতীর পরাজয়

[su_note note_color=”#f3f1c6″]দিল্লির মোগল শক্তির সঙ্গে গণ্ডোয়ানার কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু গণ্ডোয়ানার বিপুল অর্থ সম্পদ মোগল সম্রাট আকবরকে প্রলুব্ধ করে। এজন্য তিনি পূর্ব প্রদেশের মোগল সুবাদার আসফ খাঁ-র নেতৃত্বে গণ্ডোয়ানা অভিযানে এক বিশাল বাহিনী পাঠান। মোগল বাহিনী ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে গণ্ডোয়ানা আক্রমণ করে। রানি দুর্গাবতীর বিরুদ্ধে মোগল বাহিনীর আক্রমণ ছিল মোগল বাহিনীর নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ ও চূড়ান্ত অর্থলিপ্সার সুস্পষ্ট উদাহরণ।[/su_note]

  1. যুদ্ধ শুরু : বিশাল মোগল বাহিনীকে প্রতিহত করে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে গণ্ডোয়ানার রানি দুর্গাবতী তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়েই প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেন। কিন্তু বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও প্রবল বৃষ্টির কারণে এবং অন্ধকার নেমে আসায় গণ্ডোয়ানার বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।
  2. আহত বীরনারায়ণ ও দুর্গাবতী : যুদ্ধক্ষেত্রে বীরনারায়ণ আহত হলে তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিয়ে রানি যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিছু সময় পর রানি নিজেও যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের তিরের আঘাতে দারুণভাবে আহত হন এবং সেখান থেকে পিছু হঠে তাঁর দুর্গ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
  3. ব্যর্থ পরিকল্পনা : কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়। কেন-না, দুর্গে পৌঁছোতে গেলে একটি নদী অতিক্রম করতে হত। দুর্গাবতী যুদ্ধক্ষেত্রে আসার সময় সেই নদীতে জল না থাকলেও দুর্গে ফেরার সময় তা বৃষ্টির জলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে অতি অল্প সময়ে নদী অতিক্রম করা অসম্ভব ছিল।
  4. মৃত্যুবরণ : এদিকে শত্রু সৈন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে দেখে দুর্গাবতী তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অপমানিত হয়ে বাঁচার চেয়ে তিনি মৃত্যুবরণকেই শ্রেয় বলে মনে করে নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগ করেন (২৪ জুন, ১৫৬৪ খ্রি.)।

[su_divider top=”no” divider_color=”#171212″ link_color=”#161010″ size=”2″ margin=”5″]

গণ্ডোয়ানার পরিণতি

  1. ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত নররাই (Narrai)-এর যুদ্ধে দুর্গাবতীর বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে মোগলরা গণ্ডোয়ানা দখল করে।
  2. গণ্ডোয়ানার রাজপুত নারীরা আগুনে ঝাপ দিয়ে ‘জওহরব্রত’ পালন করে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করেন।
  3. গণ্ডোয়ানার ভূখণ্ডের একাংশ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অপর অংশের শাসনক্ষমতা দুর্গাবতীর বংশধর চন্দ্র শাহকে দেওয়া হয়।
  4. চন্দ্ৰ শাহ মোগলদের হাতের পুতুল হয়ে গণ্ডোয়ানার শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে গণ্ডোয়ানার গৌরবের দিন শেষ হয়ে যায়।

[su_divider top=”no” divider_color=”#171212″ link_color=”#161010″ size=”2″ margin=”5″]

Join Telegram

কৃতিত্ব

মধ্যযুগের ভারতের একজন শাসিকা হয়েও দুর্গাবতী যে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা এককথায় অতুলনীয়।

  1. দলপৎ শাহের মৃত্যুর পর গণ্ডোয়ানার চরম দুর্দিনে তিনি নিজ দেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নেন।
  2. বিভিন্ন বহিরাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন।
  3. বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি নিজ রাজকোশ সমৃদ্ধ করেন।
  4. মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টায় রানি দুর্গাবতী যে অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন নজির ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যায় না। মোগলদের হাতে গণ্ডোয়ানার পরাজয় দিয়ে রানি দুর্গাবতীর কৃতিত্বের বিচার করা অনুচিত হবে। কবি নজরুলের ভাষায় “তোমার মহাবিশ্বে কিছুই হারায় নাকো কভু।” মোগলদের হাতে গণ্ডোয়ানার স্বাধীনতা লুপ্ত হলেও রানি দুর্গাবতীর বীরত্বের কাহিনি হারিয়ে যায়নি। বীরাঙ্গনা দুর্গাবতী আজও ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তাঁর আত্মাহুতির দিনটিকে (২৪ জুন) ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ‘শহিদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
Join Telegram

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *